Saturday, 23 June 2018

কলবকে ঈমানের সাথে সুদৃঢ় রাখা। কলবের মধ্যে ঈমানকে বসিয়ে দেয়া। এই মূলনীতিটা ‘মোহরে জাব্বারিয়্যতের’ সম্পূর্ণ বিপরীত। mufti atik ullah


কুরআন বোঝার মূলনীতি: ১৪রাবতুল কুলূব (رَبْطُ القُلُوب)। -


আগেরটার সম্পর্ক কুফরের সাথে। এটার সম্পর্ক ঈমানের সাথে। 
আগেরটা কাফেরের অবস্থা বর্ণনা করেছে। এটা মুমিনের অবস্থা বর্ণনা করছে। 
বান্দা কুফরের পথ ধরলে যেমন চূড়ান্ত পর্যায়ে তাকে কুফরের উপরই স্থিত করে দেন, তদ্রুপ  বান্দা হেদায়াতের পথ গ্রহণ করলে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে হেদায়াত দান করেন। 
তারপর তাকে অবিচলতা (اِسْتِقامة) দান করেন। দ্বীনের ক্ষেত্রে পক্কতা (رُسُوخْ في الدين) দান করেন। 
এই মূলনীতির মাধ্যমেও কিছু প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করা হয়।
.


প্রথম আপত্তি:----------------------------
বদর যুদ্ধে অংশ নেয়া সাহাবীদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলার ছাড়পত্র,
اعملوا ما شئتم، فقد وجبت لكم الجنة
তোমরা যা ইচ্ছা করো, তোমাদের জন্যে জান্নাত ওয়াজিব হয়ে গেছে (আলি বিন আবি তালেব রা। বুখারি ৬২৫৯)। 
.

দ্বিতীয় আপত্তি:---------------------------
তাবুক যুদ্ধের আগে, সবাইকে সাধ্যানুযায়ী দান করতে বলা হল। সাহাবায়ে কেরাম যার যার সাধ্যানুযায়ী দান করেছেন। কিন্তু উসমান রা. সবাইকে ছাড়িয়ে গেলেন। তাঁর দানের পরিমাণ ছিল বিপুল। নবীজি সা. উসমান রা.-এর দান পেয়ে ভীষণ খুশি হলেন। বারবার বলতে লাগলেন,
ما ضَرَّعثمانَ ما عَمِلَ بعدَ اليومِ
আজকের পর, উসমান যাই করবে, (আখেরাতে) তার কোনও ক্ষতি হবে না (আবদুর রহমান বিন সামুরাহ রা.। তিরমিযী ৩৭০১)। 

.
তৃতীয় আপত্তি:---------------------------
হাদীসের বাহ্যিক অর্থটা ধরলে আপত্তি জাগে। 
وما يزالُ عبدي يتقرَّبُ إليَّ بالنَّوافلِ حتَّى أُحبَّه، فإذا أحببتُه: كنتُ سمعَه الَّذي يسمَعُ به، وبصرَه الَّذي يُبصِرُ به، ويدَه الَّتي يبطِشُ بها، ورِجلَه الَّتي يمشي بها،
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, বান্দা নফল আমলের মাধ্যমে আমার নৈকট্য অর্জন করতে করতে এমন স্তরে উন্নীত হয়, আমি তাকে ভালোবেসে ফেলি। যখন আমি তাকে ভালোবাসি, আমিই তার ‘শ্রবণশক্তি’ হয়ে যাই। সে তা দ্বারা শোনে। আমি তার দৃষ্টিশক্তি হয়ে যাই। সে তা দ্বারা দেখে। আমি তার হাতে পরিণত হই। সে তা দ্বারা অনিষ্ট প্রতিহত করে। আমি তার পদে পরিণত হই। সে তা দ্বারা হাঁটে (আবু হুরায়রা রা.। বুখারী ৩৫০৬)। 
.
এসব হাদীস দেখলে মনে হয়, বদরী সাহাবী ও উসমান রা. শরীয়ত মানতে বাধ্য (মুকাল্লাফ) নন। তাদের জন্যে সব জায়েজ। অথচ ব্যাপারটা এমন নয়। তারাও শরীয়তের আওতাভুক্ত। তারাও শরীয়ত মানতে বাধ্য। 
.________________________________-


মোহরে জাব্বারিয়্যাতের মতো রাবতুল কুলূবও চার প্রকার,

১: আল্লাহভিমুখিতা (إِنابة إلى الله)। 
প্রথম আয়াত:
আল্লাহর দিকে অগ্রসর হলে, আল্লাহ হেদায়াত দান করেন। 
وَمَا يَتَذَكَّرُ إِلَّا مَن يُنِيبُ
উপদেশ তো সেই গ্রহণ করে, যে (হেদায়াতের জন্যে) আন্তরিকভাবে রুজু হয় (মু’মিন ১৩)। 
.
দ্বিতীয় আয়াত:
হেদায়াতের পূর্বশর্ত হল, আল্লাহর অভিমুখী হওয়া। 
وَيَهْدِي إِلَيْهِ مَن يُنِيبُ
আর যে-কেউ তাঁর অভিমুখী হয় তাকে নিজের কাছে পৌঁছে দেন (শুরা ১৩)। 
.

২: হেদায়াত (هداية)। 
আল্লাহর অভিমুখী হয়েছে, তাই হেদায়াত পেয়েছে। 
إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّهُ 
(অপর দিকে) যারা বলেছে, আমাদের রব আল্লাহ! (ফুসসিলাত ৩০

.
৩: অবিচলতা (استقامة)। 
আল্লাহকে ‘রব্ব’ বলে মেনে নিয়েছে। তারপর অবিচল থেকেছে। 
ثُمَّ اسْتَقَامُوا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلَائِكَةُ
তারপর তারা তাতে থাকে অবিচলিত, নিশ্চয়ই তাদের কাছে ফেরেশতা অবতীর্ণ হবে (ফুসসিলাত ৩০)।
.

৪: রাবতুল কুলূব (ربط القلوب)। 
কলবকে সুদৃঢ়করণ। আগের তিনটা স্তর পার হয়ে এলে, আল্লাহ তা‘আলা তার কলবকে হেদায়াতের সাথে সুস্থিত করে দেন। 
نَّحْنُ نَقُصُّ عَلَيْكَ نَبَأَهُم بِالْحَقِّ ۚ إِنَّهُمْ فِتْيَةٌ آمَنُوا بِرَبِّهِمْ وَزِدْنَاهُمْ هُدًى وَرَبَطْنَا عَلَىٰ قُلُوبِهِمْ إِذْ قَامُوا فَقَالُوا رَبُّنَا رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ لَن نَّدْعُوَ مِن دُونِهِ إِلَٰهًا ۖ لَّقَدْ قُلْنَا إِذًا شَطَطًا
আমি আপনার কাছে তাদের ঘটনা যথাযথভাবে বর্ণনা করছি। তারা ছিল একদল যুবক, যারা নিজ প্রতিপালকের প্রতি ঈমান এনেছিল এবং আমি তাদেরকে হিদায়াতে প্রভূত উৎকর্ষ দান করেছিলাম। আমি তাদের অন্তর সুদৃঢ় করে দিয়েছিলাম। এটা সেই সময়ের কথা, যখন তারা (রাজার সামনেই) দাঁড়াল এবং বলল, আমাদের প্রতিপালক তিনিই, যিনি আকাশম-লী ও পৃথিবীর মালিক। আমরা তাকে ছাড়া অন্য কাউকে মাবুদ বলে কখনই ডাকব না। তাহলে তো আমরা চরম অবাস্তব কথাই বলব 

(কাহফ১৩-১৪)। 
.

একজন মানুষের যখন ‘ইনাবত’ হাসিল হয়ে যায়, তারপর ইস্তেকামত থাকে, তারপর ‘রাবতুল কুলুব’ হাসিল হয়ে যায়, তার সমস্ত কাজ আল্লাহর মরযি (চাহিদা) মোতাবেক হয়ে যায়। আল্লাহর মরযির বিপরীত কোনও কাজই তার দ্বারা সংঘটিত হয় না। বদরী সাহাবী ও উসমান রা.-এর ব্যাপারটাও ঠিক এমনি ছিল। তারা তিনটি স্তর পার হয়ে, চতুথৃ স্তর রাবতুল কুলুব হাসিল করেছিলেন। মানে তাদের দ্বারা আল্লাহর মরযির বিপরীত কোনও কাজ সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। .হাদীসের অর্থও এটাই। তারা শরীয়তের ‘মুকাল্লাফ’ নন, এই অর্থ বুঝে নেয়াটা ভুল। তাদের দ্বারা কোনও গুনাহের কাজ সংঘটিত হবে না, এটাই ছিল হাদীসের অর্থ। আগাম সংবাদ দেয়ার মতো। .



একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে,----------------------------------

ছেলেবেলা থেকেই বাবার সাথে ব্যবসা করছে। বাবা দীর্ঘদিন ধরে হাতেকলমে সন্তানকে ব্যবসা শিখিয়েছেন। সন্তানকে বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়ে তার হাতে ব্যবসা সঁপে দিয়েছেন। ঘোষণা দিয়েছেন,
-দোকান-পাট আজ থেকে তোমার হাতে ছেড়ে দিলাম। তোমার যেভাবে ইচ্ছা ব্যবসা চালিয়ে যাও। যা ইচ্ছা করো! 
বাবার কথা শুনে কি কেউ বলবে, হায় হায়, বাবা যে ছেলেকে, এতদিনের ব্যবসা নষ্ট করার অনুমতি দিয়ে দিল? অথবা ছেলেওকি বাবার কথা শুনে ব্যবসাকে লাটে তুলে দিবে? নাকি আরও বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে ব্যবসা সাজানোর চেষ্টা করবে?
.
আল্লাহ তা‘আলাও বিশেষ বান্দাকে ‘যা ইচ্ছা করার অনুমতি দিয়েছেন! তার মানে এই নয়, তাদেরকে গুনাহের ঢালাও অনুমতি দিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ জানেন, বদরী সাহাবাগণ বা উসমান রা. ভবিষ্যতে গুনাহের কাজ করবেন না, তাই তাদের ব্যাপারে এমন উদার কথা বলেছেন। 
বুখারির হাদীসটা নিয়েও একই কথা। আল্লাহ তা‘আলা প্রিয় বান্দা হাত হয়ে যান, পা হয়ে যান। মানে ওই বান্দার দ্বারা পরে আর গুনাহ সংঘটিত হবে না। যতদিন আল্লাহর প্রিয় (ওলী) হয়ে থাকবে, অন্তত ততদিন আল্লাহর মরযির বিপরীত কোনও কাজ করবে না। আল্লাহ তা‘আলা বান্দার হাত-পা কিভাবে হবেন?
لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ ۖ
কোনও জিনিস নয় তাঁর অনুরূপ (শুরা ১১)। 

.______________________________________

তাই উপরোক্ত ব্যাখ্যাটাই গ্রহণ করাই নিরাপদ। নাহলে বক্তব্যের বাহ্যিক অর্থ ধরতে শুরু করলে, দুনিয়ার কেউই নিরাপদ থাকবে না। একবার এক সাহাবী একটা কাজের কথা বললেন। উমার রা. সেকথা শুনে বললেন,
-আমরা এটা করব না। 
অথচ সাহাবীর প্রস্তাবিত কাজটি নবীজি করেছেন। বাহ্যিক দৃষ্টিতে দেখলে কেউ বলে বসতে পারে, 
-উমার রা. নবীজি সা.-এর বিরোধিতা করল?
অথচ বাস্তবতা হল, নবীজির কাজটা ‘নবীসুলভ’ ছিল। মুস্তাহাব পর্যায়ের। উম্মতের জন্যে তা বড়জোর ‘জায়েজ’ ছিল। ওই জায়েজ কাজটি উমার রা. বিশেষ কোনও পরিস্থিতিতে করা থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। হয়তো পরে কাজটা ঠিকই করেছেন। 
.
এমন প্রশ্ন পেয়ারা নবীজি সা. সম্পর্কেও ওঠানো হয়েছিল (নাউযুবিল্লাহ)। 
لِّيَغْفِرَ لَكَ اللَّهُ مَا تَقَدَّمَ مِن ذَنبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ
(হে রাসূল!) যাতে আল্লাহ আপনার অতীত ও ভবিষ্যতের সমস্ত ত্রুটি ক্ষমা করেন (ফাতহ ২)। 
.
এই আয়াতের বাহ্যিক অর্থ থেকে অল্পবুদ্ধির কেউ প্রশ্ন তুলতে পারে, নবীজির কি তাহলে গুনাহ ছিল?

 নইলে আল্লাহ তা‘আলা গুনাহ (ذنب) মাফ করার কথা বললেন যে?
এর উত্তর হল,
প্রচলিত অর্থে আমরা যেটাকে গুনাহ মনে করি,নবীগন এমন কোনও কাজ করেননি। তবে কখনো কখনো এমন হয়, দুই ভালোর মধ্যে একটা বেছে নিতে হয়। নবীগন কখনো ইজতিহাদ করে, অপেক্ষাকৃত কম ভালোটা গ্রহণ করে ফেলেন। এমন ইজতিহাদকেই কুরআন কারীমে ‘যানব’ (ত্রুটি) বলা হয়েছে। বাস্তবে কোনও গুনাহ নয়। একটা কথা আছে,
حَسَناتُ الأَبْرَار سَيِّئاتُ المُقَرَّبِيْن
নেককারদের সবচেয়ে ছোট নেকআমলও অনেক সময় আল্লাহর নৈকট্য প্রাপ্তদের কাছে ‘গুনাহ’ বলে বিবেচিত হয়। 
.
কথাটা শুধু বোঝানোর জন্যে বলা হয়। নাহলে নেকআমল কোনও অবস্থাতেই গুনাহ হতে পারে না।


No comments:

Post a Comment