♥
মতাদর্শে হিজরী ৬১ সনের ১০ মহররম ঐতিহাসিক কারবালার প্রান্তরে অত্যাচারী শাসক ইয়াজিদের বাহিনী কর্তৃক হজরত ইমাম হোসাইন রাঃ-কে যে নির্মমভাবে শহীদ করা হয়, সেই হৃদয়বিদারক মর্মান্তিক ঘটনা স্মরণেই পালিত হয় আশুরা। মহররম মাসের ১০ তারিখকে আশুরা বলা হয়। আরবি ‘আশারা’ অর্থ দশ। সেই জন্য মহররমের ১০ তারিখকে আশুরা বলে ।
. এ বছর মহররম মাস শুরু ২২ সেপ্টেম্বর থেকে।
মহররম মাসের তাৎপর্য :------------
-----------------------------------------
আল্লাহপাক এ তারিখে আসমান, জমিন, লওহে কলম সৃষ্টি করেছেন এবং এই ১০ মহররম মহাপ্রলয় বা কিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে।
আল্লাহতায়ালা আদি পিতা হযরত আদম (আঃ)-কে ১০ মহররম দুনিয়ায় প্রেরণ করেন।
মুসলিম মিল্লাতের পিতা হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ঈমানের মহা কঠিন পরীক্ষা দিতে নমরুদের অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন ১০ মহররম।
১০ মহররম খোদাদ্রোহী ফেরাউন বিপুল সেনাবাহিনী নিয়ে নীল দরিয়ার অতল তলে তুবে মরে আর হযরত মুসা (আঃ) বনি ইসরাইলদের নিয়ে পানির ওপর দিয়ে পার হয়ে যান।
হযরত ইউনুছ (আঃ) ৪০ দিন মাছের পেটে অবস্থানের পর ১০ মহররম নাজাত পেয়েছিলেন।
হযরত নূহ (আঃ) ৪০ দিনের মহাপ্লাবনের পর ১০ মহররম নৌকা থেকে বেলাভূমিতে অবতরণ করেন।
হযরত ঈসা (আঃ) ইহুদিদের অত্যাচার, নির্যাতন শূলদণ্ড থেকে মুক্তি লাভের জন্য সশরীরে চতুর্থ আসমানে উপস্থিত হন ১০ মহররম।
হযরত ইয়াকুব (আঃ) তাঁর হারানো ছেলে হজরত ইউসুফ (আঃ)- কে ফিরে পান এবং দৃষ্টিশক্তি আবার ফিরে পান ১০ মহররম।
ধৈর্য, সহনশীলতার মূর্ত প্রতীক হযরত আয়ুব (আঃ) ১৮ বছর কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত থেকে আল্লাহপাকের ইচ্ছায় ১০ মহররম আকস্মিকভাবে আরোগ্য লাভ করেন।
কাবাঘরের নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ হয়েছিল এবং ঐতিহাসিক কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা সংগঠিত হয়, যা বিশ্বের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা।
এই দিনের নেক আমল:
নামাজ: ------------------------------------
হযরত আলী (রা:) হতে বর্ণিত: রাসুলে পাক (সা:) বলেন যে ব্যাক্তি মহররমের দশম রাত্র জেগে এবাদত করবে, আল্লাহ তাকে উত্তম জীবন দান করবেন।
গাউছুল আজম হযরত আব্দুল কাদের জ্বীলানী (রহ:) বলেন যে ব্যাক্তি মহররমের দশম রাত্র জেগে এবাদত করবে, তার মৃত্যু হবে কষ্টহীন এবং আরামের।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন এক নিয়তে চার রাকাত নফল নামাজ যার প্রত্যেক রাকাতে একবার সুরা ফাতেহা, তিন বার সুরা এখলাস, এবং এক বার আয়তুল কুরসী।এভাবে নামাজ শেষে ১০০ বার সুরা এখলাস পাঠ। এভাবে নামাজ আদায় করলে গুনাহ মাফ হবে এবং জান্নাতের অসীম নেয়ামত হাসেল হবে।রাহাতুল কুলুব গ্রন্থে একবার সুরা ফাতেহা, ১০ বার সুরা এখলাস এবং ৩ বার আয়াতুল কুরসী পড়ার কথা বলা হয়েছে।
(রাহাতুল কুলুব-পৃষ্ঠা ২২৫)
গুনিয়াতুত ত্বালেবিন গ্রন্থে ১০০ রাকাত নফল নামাজের কথা বলা হয়েছে। দুই দুই রাকাত করে। প্রত্যেক রাকাতে সুরা ফাতেহা ১ বার এবং সুরা এখলাস ১০ বার। এভাবে ১০০ রাকাত নামাজ আদায় করলে সেই ব্যাক্তির উপরে ৭০টি রহমতের নযর করবেন।যার মধ্যে সর্ব নিম্নটি হলো গোনাহ মাফ।
রোযা: ------------------------------
আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেন রমজানের রোযার পরে, সবচেয়ে উত্তম রেযা হলো মহররম মাসের (আশুরার) রোযা এবং ফরজ নামাজের পরে সবচেয়ে উত্তম নামাজ হলো রাত্রীকালীন (তাহাজ্জুদ) নামাজ (মুসলিম শরীফ)
কুরআন-হাদীসের আলোকে মহররম মাস: -----------------------------
কুরআন মাজীদে ও হাদীস শরীফে মহররম মাস সম্পর্কে যা এসেছে তা হল, এটা অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ মাস। কুরআনের ভাষায় এটি ‘আরবাআতুন হুরুম’-অর্থাৎ চার সম্মানিত মাসের অন্যতম। এ মাসে রোযা রাখার প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
হযরত আবু হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত এক হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘রমযানের পর আল্লাহর মাস মহররমের রোযা হল সর্র্বশ্রেষ্ঠ।’ -সহীহ মুসলিম ২/৩৬৮; জামে তিরমিযী ১/১৫৭
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রমযান ও আশুরায় যেরূপ গুরুত্বের সঙ্গে রোযা রাখতে দেখেছি অন্য সময় তা দেখিনি।’ -সহীহ বুখারী ১/২১৮
ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) বলেন, যখন রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মাদীনাহ্তে এলেন, তখন ইয়াহূদীগণ আশুরার দিন সওম পালন করত। তারা জানাল, এ দিন মূসা (‘আ.) ফিরাউন-এর উপর বিজয় লাভ করেছিলেন। তখন নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর সহাবীদের বললেন, মূসা (‘আ.)-এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হওয়ার ব্যাপারে তাদের চেয়ে তোমরাই অধিক হাকদার। কাজেই তোমরা সওম পালন কর। [২০০৪] (আ.প্র. ৪৩১৯, ই.ফা. ৪৩২০)
সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৪৬৮০
হাদিসের মান: সহিহ হাদিস
আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, রমযান মাসের পর সর্বোত্তম সাওম হল মুহররম মাসের সাওম (আশুরার সাওম) এবং ফরয সালাতের পর সর্বোত্তম সালাত হল রাত্রের সালাত।
সুনানে আন-নাসায়ী, হাদিস নং ১৬১৩
হাদিসের মান: সহিহ হাদিস
আবূ কাতাদাহ আল-আনসারী (রাঃ) বলেন রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আরাফাহর দিনে সওম সম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হয়ে বললেন-এর দ্বারা বিগত ও আগত এক বছরের গোনাহ (পাপ) মোচন হয়। "আশুরাহর দিনের সওম পালন সম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হয়ে বললেন-বিগত এক বছরের পাপ মোচন হয়। সোমবারের দিনে সওম পালন সম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হয়ে বললেন, এটা সেদিন যেদিন আমি জন্মেছি এবং নুবুওয়াত লাভ করেছি আর আমার উপর (কুরআন) অবতীর্ণ হয়েছে।" [৭২৫]
বুলুগুল মারাম, হাদিস নং ৬৮০
হাদিসের মান: সহিহ হাদিস
হযরত আলী (রা:) কে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিল, রমযানের পর আর কোন মাস আছে, যাতে আপনি আমাকে রোযা রাখার আদেশ করেন? তিনি বললেন, এই প্রশ্ন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট জনৈক সাহাবি করেছিলেন, তখন আমি তাঁর খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘রমযানের পর যদি তুমি রোযা রাখতে চাও, তবে মহররম মাসে রাখ। কারণ, এটি আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন আছে, যে দিনে আল্লাহ তাআলা একটি জাতির তওবা কবুল করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অন্যান্য জাতির তওবা কবুল করবেন।’- জামে তিরমিযী ১/১৫৭
অন্য হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমি আশাবাদী যে, আশুরার রোযার কারণে আল্লাহ তাআলা অতীতের এক বছরের (সগীরা) গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন।’- সহীহ মুসলিম ১/৩৬৭; জামে তিরমিযী ১/১৫৮
আশুরার রোযা সম্পর্কে এক হাদীসে আছে যে, ‘তোমরা আশুরার রোযা রাখ এবং ইহুদীদের সাদৃশ্য পরিত্যাগ করে; আশুরার আগে বা পরে আরো একদিন রোযা রাখ।’- মুসনাদে আহমদ ১/২৪১
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আমি যদি আগামী বছর বেঁচে থাকি তাহলে ৯ তারিখেও অবশ্যই রোযা রাখব।’- সহীহ মুসলিম ১/৩৫৯
মহররম মাসের অপসংস্কৃতি ও বিধি-নিষেধ ----------------
মহররম মাস এলেই এক শ্রেণীর মানুষ তাজিয়া, শোকগাঁথা পাঠ, শোক পালন, মিছিল বের করা, শোক প্রকাশ্যে নিজের শরীরকে রক্তাক্ত করা প্রভৃতি কাজ করে থাকেন। এ ধরনের কোনো রেওয়াজ ইসলামের কোথাও বর্ণিত হয় নি। এসব রসম-রেওয়াজের কারণে এ মাসটিকেই অশুভ মাস মনে করার একটা প্রবণতা অনেক মুসলমানের মধ্যেও লক্ষ করা যায়।
এগুলো অনৈসলামিক ধারণা ও কুসংস্কার।
মোটকথা, ----------------------
এ মাসের করণীয় বিষয়গুলো যখা, তওবা- ইস্তেগফার, নফল রোযা এবং অন্যান্য নেক আমল। এসব বিষয়ে যত্নবান হওয়া এবং সব ধরনের কুসংস্কার ও গর্হিত রসম-রেওয়াজ থেকে বেঁচে কুরআন সুন্নাহ মোতাবেক চলাই মুসলমানের একান্ত কর্তব্য।
বলাবাহুল্য, উম্মতের জন্য এই শোক সহজ নয়। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এরই তো শিক্ষা-‘নিশ্চয়ই চোখ অশ্রুসজল হয়, হৃদয় ব্যথিত হয়, তবে আমরা মুখে এমন কিছু উচ্চারণ করি না যা আমাদের রবের কাছে অপছন্দনীয়।’
বলাবাহুল্য, উম্মতের জন্য এই শোক সহজ নয়। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এরই তো শিক্ষা-‘নিশ্চয়ই চোখ অশ্রুসজল হয়, হৃদয় ব্যথিত হয়, তবে আমরা মুখে এমন কিছু উচ্চারণ করি না যা আমাদের রবের কাছে অপছন্দনীয়।’
অন্য হাদীসে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই যারা মুখ চাপরায়, কাপড় ছিড়ে এবং জাহেলি যুগের কথাবার্তা বলে।’অতএব শাহাদাতে হুসাইন (রা)কে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের অনৈসলামিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত না হওয়া এবং সব ধরনের জাহেলি রসম-রেওয়াজ থেকে দূরে থাকা প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্য কর্তব্য।