Monday, 30 October 2017

রেসিডেন্সিয়াল গার্লসস্কুল ইন হারার (শেষপব)

রেসিডেন্সিয়াল গার্লসস্কুল ইন হারার (শেষপব)!




writer-- atikullah
-
-আপনাদের বিয়েটা কখন হল? 

-ও সেটা শোনার জন্যে বুঝি আর তর সইছে না? আমরা যখন কানাডা থেকে এলাম, তিনি কিছুদিন নিরুদ্দেশ ছিলেন। পরে বলেছেন, হারারের বাইরে এক পাহাড়ে একজন শায়খ থাকেন। তার কাছে গিয়েছিনে দ্বীনের ভুলে যাওয়া বিষয়গুলো নতুন করে শিখে নিতে। পাহাড়বাস থেকে ফেরার পর, খেয়াল করলাম তিনি আমার মুখোমুখি না হয়ে শুধু পালাই পালাই করে বেড়াচ্ছেন। অবাক হয়ে একদিন মুখোমুখি হলাম। তিনি বললেন:
-দেখ, তুমি ইসলাম সম্পর্কে মোটামুটি জেনেছ। আমি বাইরে খ্রিস্টান হলেও, ভেতরে ভেতরে মুসলিম,সেটাও জান। এটাও জান, ইসলামী শরীয়ত মতে আমাদের একসাথে কাজ করা বৈধ নয়। এতদিন করেছি বিপদের আশংকায়। প্রাণনাশের আশংকা ছিল। এখনো আছে। কিন্তু তুমি আমাকে অন্য কাজ দাও। সেখানে মেয়েদের সাথে একসাথে কাজ করতে হবে না।
-এ সমস্যার সমাধান অন্যভাবে করা যায় না?
-কিভাবে? মিস জুলির ব্যাপারে যেভাবে করেছিলেন?
-নাহ ওটা সম্ভব নয়!
-কেন সম্ভব নয়? যা হয়েছে, তারপর আমার আর বিয়ে করা চলে না!
-কেন? ইসলামে নিষেধ আছে?
-না, তা কেন থাকবে!
-তাহলে?
-প্রথমত অন্য কোনও নারীর প্রতি আগ্রহ খুঁজে পাই না। আর সব সময় জুলির কথা মনে পড়ে। এমতাবস্থায় আরেকজনকে বিয়ে করলে, তার প্রতি সুবিচার করতে পারব না। কেন জেনেশুনে একজনের সাথে বেইনসাফি করতে যাবো? আর আরেকটা বিষয় তুমি বুঝতে পারছ না!
-কোন বিষয়টা?
-আমি তোমার চেয়ে কত বড় সেটা হিশেব করে দেখেছ?
-সে তো কবেই দেখেছি! যেদিন মিস জুলির হারিয়ে যাওয়ার সংবাদ পেলাম সেদিনই। আসলে বলা ভাল, যেদিন প্রথমবার আপনাদের দু’জনকে চার্চের পাশের ঘরে একান্ত নিবিড় হয়ে সূরা ফাতিহা পড়তে দেখেছি সেদিন থেকেই!
-কী বলছ তুমি?
-আমরা রেসি স্কুলে থাকতে মনে করতাম, পুরুষ মানেই বর্বর! জানোয়ার! কারণ ফাদার থেকে শুরু করে দারোয়ান মালি পর্যন্ত সবাই আমাদের সাথে অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করতো। আপনাদের দু’জনকে দেখার আগে, একজন পুরুষ একটি মেয়ের সাথে এতটা মমতা দিয়ে কথা বলছে, এটা জানা ছিল না। কল্পনায়ও ছিল না।
-তুমি তখন কিশোরী ছিলে! মনটাও নরম ছিল! মনে রঙ ধরতে শুরু করছিল। সেটা ছিল প্রথম ভাল লাগা! তাই আমার অন্য কিছু বা বাস্তবতা তোমার চোখে পড়ছে না।
-চোখে না পড়লে না পড়–ক! আমি অন্ধ হয়েই থাকতে চাই! মিস জুলি হারিয়ে যাওয়ার পরই আমি ঠিক করেছিলাম, বাকি যে কোনও মূলে আপনার সাথেই থাকব! আমি নিয়মিত ঈশ^রের কাছে প্রার্থনা করে এসেছি এজন্য। এমনকি আপনার ও মিস জুলির ‘আল্লাহর’ কাছেও আমি নিয়মিত প্রার্থনা করেছি।
-এটা কিন্তু তোমার বোকামি! আরও ভেবে দেখ! বিয়েটা হলে তুমি কতকিছু হারাবে? চার্চ থেকে বহিষ্কৃত হবে! বন্দী হওয়াও বিচিত্র কিছু নয়!
-মরে গেলেও আমার আপত্তি নেই।
-তুমি জেনেশুনে আগুনে ঝাঁপ দিতে চাইলে, আমার কীইবা করার আছে!
.
-তাহলে এরপরই বিয়ে হয়ে গেল?
-জি¦। প্রথমে গোপন ছিল। নিরাপত্তার স্বার্থে। এমনিতেই চার্চের লোকজন আমাদেরকে সন্দেহ করতে শুরু করেছিল। সত্তরের দশকের মাঝামাঝিতে যখন সম্রাট হাইলে সেলাসির ক্ষমতা কমে আসছিল তখন থেকে আমরা আস্তে আস্তে চার্চ থেকে আলাদা হতে শুরু করেছি। ১৯৭৪ সালে সম্রাটকে গদিচ্যুত করা হয়। তার পরপরই আমরা প্রকাশ্যে ইসলামের ঘোষণা দিয়েছি। আমাদের স্কুলকেও পুরোপুরি চার্চ থেকে আলাদা করে ফেলেছি। স্কুলের জায়গা ছিল বিলালের দাদুর। তাই চার্চ কোনও আইনি ব্যবস্থা নিতে পারেনি। ভ্যাটিকানও নাক গলাতে চেয়েছিল। কিন্তু সম্রাটকে হটিয়ে ক্ষমতা দখলকারী আমান মীকাঈল আনডন ও তাকে হটিয়ে ক্ষমতা দখলকারী মঙ্গেসতু হাইলে মরিয়াম (১৯৭৪-১৯৯১) ছিলো কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন। মঙ্গেসটু দেশ থেকে ইসলাম ধর্ম পালনের বিধিনিষেধ তুলে দিয়েছিল। আমাদের কাজ অনেক সহজ হয়ে গিয়েছিল!
.
-দাদু, আপনার স্কুল কি এখন সেই আগের যুগের মতো চলছে?
-তা কি আর হয়? সম্রাটের চার দশকব্যাপী দমন-পীড়নের কারণে হারার সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছিল। লোকজনের মধ্যে বিধর্মীদের প্রভাব ঢুকে পড়েছিলা পুরোমাত্রায়। আগের সমস্ত মূল্যবোধ ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল। যুবকশ্রেণী নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। তারা দিনরাত আলকাত (Khat)-এর নেশায় ডুবে ঝিমুতো। সম্রাটও আলকাতের চাষ বাড়াতে এখানকার চাষীদেরকে উৎসাহিত করতো। তার উদ্দেশ্য ছিল, এখানকার যুবকশ্রেনীকে নেশায় ডুবিয়ে রাখা। সম্রাটের উদ্দেশ্য অনেকটাই সফল হয়েছিল। আগে এই শহরকে বলা হত, মদীনাতুল ইলমি ওয়াল ওলামা। আলেমদের শহর। এখন বলা হয়, মদীনাতুল জুহহাল।


 নিরক্ষর অজ্ঞদের শহর। সম্রাটের পরিকল্পিত সংস্কৃতিক আগ্রাসন একটা জনপদকে হাজার বছর পিছিয়ে দিয়েছে। হারারে ইসলাম এসেছিল আরব ব্যবসায়ীদের হাত ধরে। ভিন্নমতে নবীজি সা.-এর যুগেই ইসলাম এসেছিল এখানে। সাহাবায়ে কেরাম সাগর পথে মক্কা থেকে হিজরত ইরিত্রিয়া উপকূলে অবতরণ করেছিলেন। সেখান থেকে ইসলাম ক্রমান্বয়ে আদ্দিস আবাবা হয়ে হারারে এসেছিল। হারারে ইসলামের পুনর্জাগরণ হয়েছিল ১৫২০ খ্রিস্টাব্দে। ইমাম আহমাদ বিন ইবরাহীম রহ.-এর নেতৃত্বে। তিনি আরব থেকে এসে এখানকার মুসলমানদেরকে একত্রিত করে শক্তিশালী মুসলিম সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদে তিনি শহীদ হলেন ১৫৪৩ সালে। তার পরে সা¤্রাজ্যের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন আমীর নূর মুজাহিদ। তিনি ছিলেন ইমাম আহমাদ বিন ইবরাহীমের ভাগ্নে। তাকেই হারারের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। তার শাসনামলেই হারার পরিণত হয়েছিল ইলম ও জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রাণকেন্দ্রে। 

আমীর নূর মুজাহিদ হারার শাসন করেছিলেন ১৫৬৯ সাল পর্যন্ত। এখনো হারারে তার বংশধররা বাস করে। হারারের ঘরবাড়িগুলো আজো আগের মতো ইসলামী রীতিতে নির্মিত হয়। সর্বত্র ইসলামি সভ্যতার ছাপ। রাস্তাঘাট, নগরপ্রাচীর, ঘরবাড়ি সবকিছুতে। আমীর নূর মুজাহিদ গোটা হারার শহরকে প্রাচীর দিয়ে পরিবেষ্টিত করেন। পুরো শহরটা এখনো প্রাচীর বেষ্টিত। শুধু হারার শহর প্রাচীরের মধ্যেই মসজিদ ছিল ৯৩টা। বেশির ভাগই নির্মিত হয়েছিল খ্রিস্টিয় দশম শতাব্দীর আগে। 

-দাদু, আমি প্রাচীরটা দেখতে চাই!
-ঠিক আছে। আস্তে আস্তে সবই দেখবে। হারারের সর্বশেষ আমীর ছিলেন আবদুল্লাহ। তার শাসন শেষ হয়েছিল ১৮৮৭ সালে। তারপর হারার খ্রিস্টানদের হাতে চলে যায়। ইতালিয়ানরাও কিছুদিন হারার শাসন করেছিল। হারারে ইউরোপিয়ান কারো প্রবেশ করা নিষিদ্ধ ছিল। প্রথম ১৮৫২ সালে প্রথমবারের মতো একজন ইউরোপিয়ান হারারে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়। সে লোকটি ছিল বিৃটিশ গোয়েন্দা রিচার্ড ব্র্র্যাটন। আরব মুসলিম ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশ ধারন করে সে ধোঁকা দিয়ে শহরে প্রবেশ করেছিল। রিচার্ড অনর্গল আরবীতে কথা বলতে পারত। এই ব্রিটিশ চরই পরে হারার সম্পর্কে লেখালেখি করেছিল। তার লেখার সূত্র ধরে সবার লোলুপ দৃষ্টি পড়েছিল হারারের উপর। দীর্ঘকাল ধরে ইথিওপিয়ান সা¤্রাজ্য ও হারারের ইসলামি সালতানাত পাশাপাশি বাস করে আসছিল। ইথিওপিয়ার ইউহানেস চতুর্থ (১৮৭১-১৮৮৯) হারার দখল করে নেয় ১৮৮৭ সালে। আচ্ছা, অনেক কথা হল, এখন বল আগামীকাল প্রথমে কী দেখতে যাবে?
-লাইব্রেরী!
-বাহ, খুব ভাল! তোমাকে আমি শায়খ শরীফের লাইব্রেরিতে নিয়ে যাব প্রথমে। সেখানে প্রায় এগারশ বছরের পুরনো কুরআনের নুসখা আছে। হাতে লেখা। এবং সেটা এখানকার মেয়েরাই লিখেছে। সেই মাদরাসাতুল উম্ম-এর প্রথম দিককার কোনও এক ছাত্রী। কী সুন্দরই না হয়েছে সেটা, দেখলে বুঝতে পারবে! কুরআন শরীফটা হাতে নিলে তোমার বিশ^াস করতে কষ্ট হবে, সেটা কোনও এক মেয়ের হাতের লেখা!
-দাদু, আমার কী ইচ্ছে করছে জানো?
-কী?
-তোমার স্কুলে ভর্তি হয়ে যেতে! তোমার কাছে থেকে যেতে!
-বিশে^র সেরা স্কুল ফেলে হারারের এই ঘুপচির স্কুল ভাল লাগবে বুঝি?
-তুমি যেভাবে স্কুলের ইতিহাস বললে, সত্যি সত্যিই লোভ জাগছে! আমি বড় হলে এমন একটা স্কুল খুলব! দেখে নিও!
-আচ্ছা, সে সময় হলে দেখা যাবে! 

.
তিনদিন পর জুমাইমা চলে গেল। আঙ্কল একজন লোক পাঠিয়েছিলেন নিয়ে যাওয়ার জন্যে। জুমাইমা আরও থাকতে চেয়েছিল। সে দাদুর স্কুল (মাদরাসা) নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করতে শুরু করে গিয়েছিল। দাদুকে তার এত ভাল লেগেছে, সে সব ছেড়েছুড়ে দাদুর কাছে থেকে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু তা কী করে হয়! সে চলে যাওয়াতে দাদু ভীষণ একা হয়ে গেলেন। কয়টা দিন তার কথা বলার সঙ্গী পেয়ে সময়গুলো ভালোই কেটেছিল। আমি আরও কিছুদিন দাদুর কাছে থাকলাম। দাদুকে একাকী রেখে আদ্দিসআবাবায় যেতে মন চাচ্ছিল না। আঙ্কল রোনে এর মধ্যে দু’বার ফোন করেছেন। তাড়াতাড়ি চলে যেতে বলেছেন। দাদুও বারবার তাগাদা দিচ্ছিলেন। অগত্যা বের হতে হল। দাদুকে ছেড়ে যেতে মনটা কিছুতেই সায় দিচ্ছিল না। না গিয়েও উপায় নেই। শেষ পরীক্ষাটা দিতে হবে। আদ্দিসআবাবায় পৌঁছার পর শুনলাম, জুমাইমা মা-বাবার কাছেও বলেছে সে আর ফিরে যাবে না। দাদুর কাছে থেকে যাবে। তার সাথে থেকে পড়বে ও গার্লস স্কুলের ছাত্রীদের মতো নিজেকে গড়ে তুলবে! আঙ্কল মেয়ের গাগলামি দেখে মিটিমিটি হেসেছেন। শুধু বলেছেন,
-ওটা তো মুসলিমদের!

-নাহ, ক্রিশ্চান মেয়েরাও পড়ে। মুসলিম ও ক্রিশ্চানদের আলাদা আলাদা সিলেবাস।
এবার আন্টি মুখ খুললেন। শক্ত কণ্ঠে বললেন, তুমি কানাডাতেই পড়বে। এবং পড়াশোনা শেষ করার আগে আর এখানে আসারও দরকার নেই। তোমার আব্বুও বদলি হয়ে যাবেন আগামী বছর। মাথা থেকে এসব ভূত নামাও। মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়ায় কর। আগামী সপ্তাহেই তুমি ফিরে যাবে। টিকেট কাটা হয়ে গেছে।
.
জুমাইমা এবার আমাকে ধরল। আমিও আন্টির মতো কঠিন অবস্থান নিলাম। আর যাই হোক, আমি কিছু বললে, জুমাইমা সেটা বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিত। এবার একটু দোনোমনো করলেও মেনে নিয়েছে। সে ইউরোপিয় ঘরানার মেয়ে হলেও মন-মানসিকতা পুরোপুরি ইউরোপিয় পায়নি। এটা কি শৈশব-কৈশোর কানাডার বাইরে আফ্রিকার মাটিতে কাটানের ফল? কে জানে, হতেও পারে। আমি পরীক্ষার প্রস্তুতিতে ডুবে গেলাম। দিনরাত, আশপাশ সবকিছু ভুলে গেলাম। দাদুর কথাও সব সময় মনে ছিল না। ভেতরে কোত্থেকে একটা জেদ এসে গিয়েছিল। আমাকে পরীক্ষায় ভাল করতে হবে। মেডিকেলে ভর্তি হতে হবে। 
পুরো হারার শহরে একজনও মুসলিম ডাক্তার নেই। চার্চের ডাক্তার দিয়ে কাজ চালাতে হয়। মিশনারী ডাক্তারগুলো পুরোমাত্রায় এ শূন্যস্থানের সুযোগ নিতে কসুর করে না। আমি একজন ডাক্তার হতে পারলে, আমার দেখাদেখি অন্যরাও সাহস পাবে। আরও আগেই মুসলিম ডাক্তার বেরিয়ে আসত! হারারের আলিমগণের ভুল সিদ্ধান্ত সবাইকে ভোগাচ্ছে। তারা সবাইকে বুঝিয়েছেন, এসব পড়াশোনা খ্রিস্টানদের বিষয়। মুসলিম ছেলেরা পড়তে গেলে ঈমান থাকবে না। খ্রিস্টান হয়ে যাবে নয়তো নাস্তিক হয়ে যাবে। মুসলিম ছেলেরা শুধু কুরআন কারীম ও হাদীস শরীফ নিয়ে থাকবে!
-তাহলে চিকিৎসাসহ অন্য প্রয়োজন কিভাবে পুরো হবে?
-আল্লাহ তা‘আলা খ্রিস্টান ও বিধর্মীদেরকে আমাদের কাজে নিয়োজিত করে দেবেন!
-পর্দানশীন নারীদের চিকিৎসা কিভাবে হবে?
-শরীয়ত লঙ্ঘন করে চিকিৎসার কী প্রয়োজন?
.
এই ছিল তাদের চিন্তা। নিজেদের বদ্ধ চিন্তাকে দ্বীনের নামে চালিয়ে দিতো। এদিকে মুসলমানরা খ্রিস্টান ডাক্তারদের ফাঁদে পা দিয়ে দলে দলে খ্রিস্টান হয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ ধর্মান্তরিত না হলেও, মতান্তরিত হয়ে যাচ্ছে। তারা শত বছরের ধর্মীয় ঐতিহ্যকে অস্বীকার করে ধর্মমুক্ত জীবন যাপনে উদ্বুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। মেয়েরা দলে দলে অন্য শহরে গিয়ে কফি হাউজ আর বারে চাকুরি নিচ্ছে। অবস্থা বেগতিক দেখে, দাদাভাই, আব্বুসহ অভিজ্ঞরা বৈঠকে মিলিত হলেন। দাদু গার্লস স্কুলের মতো বয়েস স্কুল খোলার প্রতি গুরুত্ব দিলেন। 

অথবা ধর্মীয় মাদরাসাগুলোর সিলেবাসকে ঢেলে সাজানোর পরামর্শ দিলেন। তা যদি সম্ভব না হয়, অন্তত উল্টাপাল্টা ফতোয়া না দেয়া হয়, সেটা নিশ্চিত করা। মানুষকে বিভ্রান্ত করে এমন কথা যেন কোনও ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব থেকে না আসে। যারা এ-ধরনের উল্টাপাল্টা ফতোয়া দেয়, তাদের প্রায় সবাই বলতে গেলে ধর্ম সম্পর্কে কোনও জ্ঞানই রাখে না। তাদের কুরআন পড়াও শুদ্ধ নেই। দশকের পর দশক খ্রিস্টানদের চাপিয়ে দেয়া আগ্রাসনে সুষ্ঠু ধর্মীয় ব্যাহত হয়ে যাওয়াতেই সমস্যাগুলোর সৃষ্টি হয়েছে। অর্ধশিক্ষিত বা নামমাত্র শিক্ষিত মানুষগুলোই আলিম পরিচিতি পেয়ে যাওয়াতে সমস্যা তৈরী হয়েছে। ক্রমশ স্থবির হয়ে আসা হারারের মুসলিম জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করতে হলে, দ্বীন ও দুনিয়া উভয় ঘরানার শিক্ষা নিয়ে আসতে হবে বাইরে থেকে। এখানকার সবকিছুতে জড়তা ধরেছে।
.
জুমাইমা আজ চলে যাবে। সে এয়ারপোর্টে যাওয়ার আগেও বলে গেছে, তার যেতে ইচ্ছে করছে না। আমি কিছু বলিনি। একবার ভেবেছিলাম, জুমাইমা চলে যাওয়ার আগে বাসায় থাকব না। তার ব্যাপারটা আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। সে কেন থাকার জন্যে এমন গোঁ ধরে আছে? ব্যাপারটা নিয়ে বেশি ভাবার ফুরসত মিলল না। পরীক্ষা এসে চলেও গেল। আমার পাশে সিট পড়েছিল একজন ইরিত্রিয়ানের। আসা-যাওয়ার পথে কথা বলতে বলতে মোটামুটি একটা সম্পর্ক গড়ে উঠল। পরীক্ষা শেষ হওয়ার দু’দিন আগে সে প্রস্তাব দিল,
-আমাদের বাড়িতে বেড়াতে যাবে?
-ইরিত্রিয়ায়?
-জি¦।
-কিন্তু ওখানে তো যুদ্ধ লেগেই আছে।
-তুমি জানো, আমরা যুদ্ধ করতে চাইনি, আমাদের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। হাইলে সেলাস দীর্ঘ শাসনামলে (১৯৩০-১৯৭৪) পুরো সা¤্রাজ্য জুড়ে মুসলমানদের উপর চরম দমন পীড়ন চালিয়েছিল। এই অত্যাচারী মুসলিম বিদ্বেষী স¤্রাট আক্রোশবশত ১৯৫২ সালে আমাদের ইরিত্রিয়া দখল করে নিয়েছিল। ইথিওপিয়া অন্যায়ভাবে আমাদের দেশ দখল করে নিয়েছে। তুমি জানো ইরিত্রিয়ার বেশির ভাগ অধিবাসী মুসলমান। বিধর্মীয় কোনও বাহিনী মুসলিম ভূমি দখল করে নিলে, প্রতিরোধ গড়ে তোলা ফরয হয়ে যায়। আমরা ফরয আদায় করছি মাত্র। তুমি গেলে আমি খুশি হব। আমাদের কষ্টগুলো কাছে থেকে দেখে আসবে। তোমাদের হারারের উপরও আদ্দিস আবাবা দীঘদিন ধরে দমননীতি গ্রহণ করে আসছে। আমাদের ওখানটা ঘুরে এলে তুমিও হারার সম্পর্কে নতুন কোনও চিন্তার দিগন্ত পাবে!
-আমি দাদুর অনুমতি ছাড়া যেতে পারব না!
-আমি পরীক্ষা শেষ হলেই চলে যাব! তুমি দাদুর সাথে দেখা করতে গেলে, আমাকে অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়।
-আচ্ছা, পরীক্ষা শেষ হলে দেখা যাবে।
.
বেশি চিন্তা না করে ইরিত্রিয়া যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। দাদুকে জানাবনা ঠিক করেছি। জানতে পারলে তিনি যেতে নাও দিতে পারেন। আঙ্কলকে জানাব কি জানাব না দোটানায় পড়ে গেলাম। শেষমূহুর্তে সিদ্ধান্ত নিলাম, বাড়ি যাচ্ছি ভাব নিয়ে আঙ্কল আন্টির কাছ থেকে বিদায় নেব। বন্ধুর বাড়ি রাজধানি আসমারার শহরতলিতে। দাদুর আব্বুও এখানে এসেছিলেন। ইতালিয়ানদের বিরুদ্ধে জিহাদে অংশ নিতে। এবার আমি এলাম। ইরিত্রিয়ার প্রতি আমাদের হারারী মুসলমানদের জন্মগন টান। এ দেশ সাহাবায়ে কেরামের স্মৃতি বিজড়িত।

চারদিকে ঘোরা শেষ হল। রাজধানীর বাইরেও যাবো বলে স্থির করলাম। হাতে সময় আছে অল্প ক’টা দিন। এরপর বন্ধু তার কাজে চলে যাবে। আমাকে সময় দিতে পারবে না। আমারও বেড়ানো শেষ হয়ে গেছে। ফিরে যাওয়ার বন্দোবস্তি শুরু করে দিলাম। এমনি কথাচ্ছলে জানতে চাইলাম,
-তুমি কোন কাজে যাবে?
-আছে একটা। তোমাকে বলা যাবে না!
-বলোই না, গুরুত্বপূর্ণ কিছু হলে, আমিও তোমার সাথে যাবো!
-আমি সীমান্তে যাচ্ছি। ওখানে মুজাহিদ বাহিনীর সাথে যোগ দেব। ইথিওপিয়ার জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।
-আমিও যাবো। নেবে?
-নতুন কাউকে নিতে হলে ছাড়পত্র নিতে হয়। আমি আগামীকাল যোগাযোগ করে তোমাকে জানাব। আশা করি পেয়ে যাব। তোমার সম্পর্কে আগেও আমীর সাহেবকে জানিয়েছি।
বাড়ি যাচ্ছি না দেখে দাদু চিন্তা করবেন। কিভাবে তার কাছে খবরটা পৌঁছানো যায় ভাবছি। সরাসরি বললে, সরকারি গোয়েন্দারা জেনে যাবে। এমনিতেই সরকার মুসলমানদেরকে সন্দেহের চোখে দেখে। ইরিত্রিয়ায় আক্রমণ করার পর সন্দেহের মাত্রা আরও বহুগুণ বেড়ে গেছে। সমস্যাটা বন্ধুকে জানালাম। সে হেসেই উড়িয়ে দিল।
-ও এই কথা! তুমি মোটেও চিন্তা করো না। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই তোমার দাদুকে জানানোর ব্যবস্থা করছি!
-কিভাবে?
-পুরো ইথিওপিয়াতেই আমাদের লোকজন আছে। তোমাদের হারারেও আছে। কী জানাতে হবে বলো!
-শুধু জানাতে হবে, আমি ভাল আছি। একজায়গায় বেড়াতে এসেছি। ফিরে গিয়ে বিস্তারিত বলব। বিশেষ কারণবশত বলে আসা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি।
-তোমার দাদু কি বেশি বৃদ্ধ? মানে তোমার সাহায্য ছাড়া চলতে পারেন না এমন?

-নাহ! আমার দাদু এখনো পুরোপুরি শক্ত ও কর্মঠ। চব্বিশ ঘণ্টাই কোনও না কোনও কাজে ব্যস্ত। ছাত্রী পড়াচ্ছেন। ছাত্রীদের রান্নাবান্না তদারক করছেন। আমি না হলেও তার অগণিত ছাত্রী আছে। তারা তাকে মাথায় করে রাখে। দাদাভাই শহীদ হওয়ার পর বুকভাঙা শোকও তিনি ছাত্রীদের সযত পরিচর্যায় কাটিয়ে উঠেছিলেন। তিনি মানুষটা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের। তিনটা সম্পূর্ণ ভিন্ন সভ্যতাকে বুকে ধারন করে আছেন। জন্মসূত্রে পেয়েছেন রেড ইন্ডিয়ান সভ্যতা। বেড়ে ওঠা ও লেখাপড়ার সূত্রে পেয়েছেন ইউরোপিয়ান সভ্যতা। 
দাম্পত্য ও কর্মজীবনের সূত্রে পেয়েছেন আফ্রিকান সভ্যতা। দাদুর চিন্তা কতটা স্বচ্ছ আর বাস্তবসম্মত একটা ঘটনা বললেই পরিষ্কার হবে! গাড়ি দুর্ঘটনায় পরিবারে প্রায় সবাই মারা যাওয়ার পর আমি বাড়ি গিয়েছি। দাদুকে দেখে অবাক। তিনি সারাক্ষণই কাঁদছেন কিন্তু কাজেকর্মে কথাবার্তায় তার কান্নার কোনও প্রভাবই পড়তে দেননি। আগের রুটিনেই স্বাভাবিক ছন্দে দৈনন্দিন কাজ চালিয়ে গেছেন।
-তাকে একবার দেখার বড় সাধ জাগছে।
-তিনি তোমার সাথে দেখা দেবেন না।
-কথাও বলবেন না?
-জি¦, বলবেন।
-তাহলেই হবে। তার কাছে আমার অনেক কিছু জানার আছে। প্রশ্ন করার আছে।
-ঠিক আছে, হায়াতে বেঁচে থাকলে তোমাকে নিয়ে যাবো। ইনশাআল্লাহ।

শুরু হল নতুন জীবন। প্রশিক্ষণপর্ব দ্রুত সমাাপ্ত হল। সরাসরি জিহাদের ময়দানে অবতীর্ণ হলাম এক ভোরে। মধ্যরাতে তাহাজ্জুদ পড়ে রওয়ানা দিলাম, বহুদূরের পায়ে হাঁটা পথ। পাহাড় ডিঙ্গাতে হবে কয়েকটা। নিজের জীবনকে এতদিনে সার্থক মনে হচ্ছিল। যুগে যুগে হকের ঝা-া উঁচিয়ে ধরা দলের নগন্য একজন সদস্য হতে পেরে মনটা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতায় নুয়ে আসছিল। প্রতি রাতেই কোনও না কোনও ফ্রন্টে লড়াই চলত। 

এ ছিল এক অসম যুদ্ধ। ইথিওপিয়ার সাথে ছিল আমেরিকা ব্রিটেনের মতো বড় বড় শক্তি। আমাদের সাথে আরবের সামান্য অর্থ সাহায্য। আল্লাহ তা‘আলার প্রতি আনুগত্য আর আমাদের প্রতি তার অশেষ করুণাই ছিল আমাদের প্রধান পাথেয়। এত আত্মত্যাগ আর কুরবানির মধ্যেও একটা বিষয় মনে সারাক্ষণ খচখচ করে বিঁধত।
 ইরিত্রিয়ার পক্ষে বিভিন্ন দল লড়ছে, প্রায় সবাই জিহাদের আদর্শ নিয়ে লড়ছে না। তারা লড়ছে জাতীয়তাবাদ আর ভূরাজনৈতিক আদর্শে প্রভাবিত হয়ে সংকীর্ণ মানচিত্রের মোহে। তাদের একটা জাতীয় পতাকা হবে। তাদের একটি স্বতন্ত্র মানচিত্র হবে। তাদের একটি পার্লামেন্ট হবে। তারাও অন্যদের মতো জাতিসংঘের সদস্য হবে। তারাও ওআইসির সদস্য হবে। তারাও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংঘের সদস্য হবে। এই নিয়ে সুখস্বপ্নে বিভোর থাকত। ইসলাম ও শরীয়াহ নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা ছিল না। তাদের আদর্শ কমুনিজমঘেঁষা ধর্মনিরপেক্ষ শাসনব্যস্থা। 

আমাদের দলটা এখন লড়ছে মুয়সাওয়া (গধংংধধি) শহরে। দেখতে দেখতে অনেক দিন হয়ে গেল ময়দানে এসেছি। জিহাদের ময়দানে একবার এলে বাড়িঘরে ফিরতে মন চায় না। সারাক্ষণ শুধুই জান্নাতের চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকে মাথায়। শাহাদাতের সুতীব্র নেশায় পেয়ে বসে। মুজাহিদ বাহিনী তাদের ঘাঁটি হিশেবে মুসাওয়া শহরকে বেছে নেয়ার একটা কারণ আছে। সাহাবায়ে কেরামের প্রথম দলটি হিজরত করে দীর্ঘ মরু ও সাগরপথ পাড়ি দিয়ে এই মুসাওয়াতেই অবতরণ করেছিলেন। ইসলামের প্রথম মসজিদও এই শহরেই স্থাপিত হয়েছিল। মসজিদটি রাসে মুদার (رأس مدر) নামে পরিচিত। সাহাবায়ে কেরামের হাতে। 
তারা হিজরত করেছিলেন হিজরতের আট বছর আগে রজব মাসে। ৬১৪ খ্রিস্টাব্দে। কত আগের ঘটনা, মনে হয় এই তো সেদিনের কথা। আমি কল্পনার চোখে দেখতে পাচ্ছি, সাহাবায়ে কেরাম নৌকা থেকে নামছে। একজন উম্মুল মুমিনীনও আছেন! আরও কত দৃশ্য ভাসছে। সাহাবায়ে কেরামের পদধূলির বরকতে এখানে স্বাধীন এক মুসলিম সালতানাত গড়ে উঠেছিল। সাগর পেরিয়ে মিসরের আসওয়ান পর্যন্ত এর সীমানা বিস্তৃত ছিল। ৯২৩ সালে তুর্কি সুলতান সলীম এ-সালতানাতকে উসমানি খিলাফার অধীনে নিয়ে যান।

আমাদের মুজাহিদ বাহিনী মরণপণ লড়াই চালিয়ে যেতে লাগলেন। যুদ্ধের মোড় আস্তে আস্তে ঘুরতে লাগল। ইথিওপিয়া আলোচনায় বসতে সম্মত হল। আমাদেরকে ছাড়াই বৈঠক শুরু হল। মুজাহিদ বাহিনী কোনও প্রকারের আলোচনার পক্ষপাতিও ছিল না। ইরিত্রিয়া স্বাধীন হল। ক্ষোভে দুঃখে সবাই চুল ছেঁড়ার উপক্রম। এতদিন আমরা লড়লাম। আমাদের দলের বাইরের দলগুলোতে অন্য শিরোণামে সাধারণ মুসলমানরা লড়ল। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে বসল একজন কমুনিস্ট অর্থোডক্স খ্রিস্টান। আসিয়াস আফওয়ার্কি। মুজাহিদ বাহিনীতে দ্বিধা তৈরী হল। লড়াই চালিয়ে যাবে নাকি আপাতত রণে ভঙ্গ দিবে। লড়াই চালিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। তাহলে আমাদেরকে লড়তে হবে এখন দুই শত্রুর সাথে। ইথিওপিয়া ও ইরিত্রিয়ান সৈন্যদের সাথে। এতদিন যাদের সাথে মিলে শত্রু তাড়িয়েছি এখন তাদের দিকে বন্দুক তাক করতে হবে। কী করা যায়, সিদ্ধান্তে পৌঁছা যাচ্ছিল না। চিন্তা চললেও, সীমান্তে ইথিওপিয়ান বাহিনীর বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলছিল। 

এর মধ্যে পেরিয়ে গেছে একটা বছর। দাদুকে নিয়মিত খবর পাঠিয়েছি। লোক মারফত জানিয়েছি, কোথায় আছি, কী করছি! আমাকে নিয়ে দাদু কী ভাবছেন সেটা জানার কোনও উপায় ছিল না। দিনদিন অবস্থা আরও করুণ হয়ে উঠছে। চারদিক থেকে ঘেরাওয়ের মধ্যে আছি। খাবারের সংকট দেখা দিল। অস্ত্রও প্রায় ফুরিয়ে গেছে। প্রেসিডেন্ট আসিয়াস আমাদেরকে অস্ত্র সংবরণ করতে অনুরোধ করলেন। নইলে কঠোর ব্যবস্থার হুমকি দিলেন। আমরা ছোট্ট জায়গার মধ্যে ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে গেলাম। আামাদের সামনে তিনটা পথ খোলা রইল:

১: আত্মসমর্পন।
২: সরকারী বাহিনীতে যোগদান।
৩: ঘেরাও ভেঙে কৌশলে চোখে ধূলো দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া। পরে সুযোগ বুঝে প্রস্তুতি নিয়ে আবার ময়দানে ফেরা।
পরামর্শে শেষটা প্রাধান্য পেতে লাগল। আমীর সাহেব বারবার বৈঠকে বসছেন। সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না। একরাতে, আমরা গোপন শেল্টারে বসে আছি। আমীর সাহেব এসে বললেন, তোমার সাথে এক ভদ্রলোক দেখা করতে এসেছেন। আমি অবাক, এখানে কে আসবে? কে আসতে পারে? ভাবতে ভাবতে মাথা ব্যথা হয়ে গেল, কূলকিনারা করতে পারলাম না। কোনও হদিস বের হল না। বাংকার ছেড়ে বাইরে এলাম। আমীর সাহেবের সাথে অনেকক্ষণ হাঁটার পর বড় রাস্তার পাশের এক ছোট্ট গলিপথে নামলাম। ঘুটঘুটে অন্ধকারেও আবছা আবছা দেখতে পেতাম। ময়দানে থাকার সুফল। সামনে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আমীর সাহেব আমাকে রেখে চলে গেলেন। দ্বিধা নিয়ে গাড়ির কাছে গেলাম। কাছে যেতেই চালকের দরজা খুলে গেল। দীর্ঘকায় একজন মানুষ নামলেন গাড়ি থেকে। আরেকটু যেতেই চমকে গেলাম। আঙ্কল রোনে। আকাশ থেকে পড়ার মত অবস্থা! তিনি এখানে? অসম্ভব!
-কেমন আছ ‘সন’?

-ভাল আছি! আপনি কেমন আছে? আন্টি কেমন আছেন? আর জুমাইমা?
-সবাই ভাল আছে। আমি তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি!
-আপনি এখানে কিভাবে এলেন?
-সেটা পরে শুনো!
-এখন আমার সাথে চলো! গাড়িতে উঠো!
-কিন্তু আপনার সাথে আমার যাওয়া সম্ভব নয়। আমরা একটা কাজে আছি!
-আমি সব জানি! সবদিকে খোঁজখবর করে তবেই তোমাকে নিতে এসেছি!
-আমি আমার দলের সাথে বেঈমানি করতে পারব না। আমার আদর্শের সাথে বেঈমানি করতে পারব না।
-সেসব কিছুই করতে হবে না। আচ্ছা, এদিকে এসো।
অঙ্কল আমার হাত ধরে গাড়ির পেছনের দরজার কাছে নিয়ে দাঁড় করিয়ে বললেন:
-তোমরা কথা বল। আমি আসছি।
বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছি। পেছনের দরজা খুলে গেল। সালামের শব্দ শুনে চমকে উঠলাম,
-জুমাইমা?
-জি¦, আমি।
-স্বপ্ন দেখছি নাতো! তুমি তুমি এখানে কী করে এলে?
-সে অনেক কথা! আপনি আমাদের সাথে চলুন। আপনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে আমি সেই টরেন্টো থেকে ছুটে এসেছি।
-না জুমাইমা তা হয় না।
-কেন হয় না?
-আমাকে কাপুরুষ হতে বলছ? বেঈমান হতে বলছ?
-জি¦ না। আমি আপনাকে সব সময় বীরপুরুষ এবং ঈমানদার হিশেবেই কল্পনা করি। অতীতেও করেছি। ভবিষ্যতেও করে যাব। আমি একা ফিরে গেলে দাদু ভীষন কষ্ট পাবেন। তিনিই বড়মুখ করে আমাকে পাঠিয়েছেন। কেন পাঠিয়েছেন বুঝতে পারছি না। আমি বললেই আপনি আমার কথা ধরে ফিরে যাবেন, এটা বিশ^াস হতে চায়নি। তবুও দাদু অভিজ্ঞ মানুষ। তার কথা খুব কমই ভুল হতে দেখেছি।
-তুমি আমাকে দ্বিধায় ফেলে দিলে দেখছি!
-আপনি আপনার আমীর সাহেবের সাথে কথা বলে আসুন। নিজেকে বেঈমান আর কাপুরুষ মনে হবে না।
-বা রে, বেশ প্রস্তুতি নিয়েই এসেছ দেখছি! আর তুমি এত সমঝদার কী করে হয়ে গেলে? দেড় বছরের মধ্যে এমন মুরুব্বি হয়ে গেলে?
-দাদুর সাথে থেকে থেকে!

-তোমার কথাবার্তা রহস্যময় হয়ে উঠছে। আচ্ছা, আমি আমীর সাহেবের সাথে কথা বলি।
আমীর সাহেব কাছেই ছিলেন। আমাকে রেখে চলে যান নি। আঙ্কলের সাথে কথা বলছিলেন। তিনি বললেন:
-বেলাল, সিদ্ধান্তটা সঠিক হচ্ছে কি না জানি না। আমাকে তোমরা সিদ্ধান্তের ভার দিয়েছ। আমি অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করেছি, আপাতত আমাদের দলটা ভেঙে দেব। এই ভদ্রলোক আমাদের জন্যে সাগরপথে বেরিয়ে যাওয়ার একটা এস্কেপ রুট ঠিক করেছেন।
-আমাকে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছেন তাহলে?
-জি¦, চলে যাও। ইনশাআল্লাহ শিঘ্রিই আমাদের আবার দেখা হবে। আমরা আগামীতে আবার মিলিত হবো আজকের আরদ্ধ কাজকে এগিয়ে নেয়ার জন্যে। 

.
চলে এলাম। গাড়িতে চুপচাপ বসে আছি। গাড়ি ছুটে চলছে আসমারার দিকে। অসহ্য নিরবতা ভাঙলেন আঙ্কল।
-তোমার কি মন খারাপ?
-এখনো ঠিক বুঝতে পারছি না! ভেতরটা অনুভূতিশূন্য। কিভাবে কী হল, খুলে বলুন তো?
-ঘটনা বেশি নেই। দেশ স্বাধীন হল, তুমি বেঁচে আছ, তারপরও বাড়ি ফিরছ না, তাই তোমার দাদু উদ্বিঘœ হয়ে উঠলেন। তোমার দাদুর সাথে জুমাইমার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। তোমার নিরুদ্দেশ হওয়ার সংবাদ শুনে আমরা সবাই মুষড়ে পড়েছিলাম। সরকারী কোনও সংস্থা তোমাকে উঠিয়ে নিল কি না, ব্যাক্তিগত কানেকশন কাজে লাগিয়ে খোঁজ নিলাম। পরে তোমার দাদুই খবর পাঠাল ভাল আছ। জুমাইমাও সামারের ছুটিতে বেড়াতে এসেছিল ওর মায়ের কড়া নিষেধাজ্ঞা ঠেলে। মেয়ে থাকবে বাবা-মায়ের কাছে, তা না করে, সে দু’টা দিন থেকেই হারার ছুটল। তোমার দাদু কী জাদু করেছেন কে জানে! পুরো ছুটিই ওখানে কাটিয়েছে। বাধ্য হয়ে তোমার আন্টিও ওখানে কিছুদিন থেকে এসেছে। তারপর থেকে তোমার আন্টির মুখ থেকেও তোমার দাদুর প্রশংসা বের হতে শুরু করল। আগে নিজেই মেয়েকে বাধা দিত। এখন আমিই বাধা দিয়ে রাখতে পারি না। কিছুদিন পরপরই সে হারার ছুটে যায়।
-আপনাদের সবার প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা। দাদুকে দেখে রেখেছেন।
-কী বলছ তুমি, আমরা তোমার দাদুকে দেখে রাখব কি, উল্টো উনিই আমাদের সবাইকে দেখে চোখে রেখেছেন।
-এক বছর পর আপনার বদলির কথা ছিল।
-জি¦। আমাকে ইরিত্রিয়ায় বদলি করা হয়েছে। এতদাঞ্চল সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতার কথা মনে রেখেই হয়ত কৃর্তপক্ষ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি চেয়েছিলাম কানাডা ফিরে যেতে। টানাহ্যাঁচড়ার কারণে জুমাইমার লেখাপড়া হচ্ছে না ঠিকমত। তা হল না। 

-আমার অবস্থান কিভাবে বের করলেন?
-তোমার দাদু জুমাইমাকে চিঠি লিখেছিল, আমাকেও লিখেছিল, তোমাকে ফিরিয়ে নেয়ার কোনও ব্যবস্থা করতে। বিশেষ করে জুমাইমাকে বলেছিল। জুমাইমার অনুরোধ নাকি তুমি ফেলতে পারবে না। তাই শুধু তোমার জন্যে আমি তাকে কানাডা থেকে উড়িয়ে এনেছি। তোমার দাদীমার কথা ফেলি কী করে! তিনি আমাদের কানাডার গর্ব। তার মতো মেয়ে আমাদের দেশে জন্ম নিয়েছে, ভাবতেই ভাল লাগে।
-এখানে এলেন কিভাবে?
-আমি প্রথমেই বিভিন্ট ফ্রন্টে খোঁজ লাগালাম। খবর বের করতে দেরী হল না। তারপর লোক পাঠিয়ে তোমার আমীরের সাথে যোগাযোগ করলাম। তাকে পরিস্থিতি বুঝিয়ে বললাম। তোমাদের দল তৎপরতা বন্ধ না করলে ভয়ংকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে, সেটাও বললাম। এখন যুদ্ধকৌশলে পরিবর্তন আনতে হবে, এটা বুঝিয়ে বলেছি তোমার আমীরকে।
-কারা সেই পরিস্থিতি তৈরী করবে?
-ইসরায়েল ও আমেরিকা।
-ইহুদিরা এখানে কিভাবে এল?

-তোমরা ফ্রন্টে থেকে কোনও খোঁজই রাখ না। এখনকার দিনে শুধু ফ্রন্টলাইনে যুদ্ধ করলেই চলে না ইয়ংম্যান! চারদিকেও চোখ রাখতে হয়। চট করে কেন ইথিওপিয়া স্বাধীনতা দিতে রাজী হল? এতদিন ধরে যুদ্ধ চালাল, আরও চালাতে পারত! আসলে পর্দার আড়ালে কিছু খেলা হয়ে গেছে। ইরিত্রিয়া মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। কিন্তু দেশের প্রধান একজন খ্রিস্টান! এটা হয়েছে গোপন সমঝোতা চুক্তির আওতায়। সমঝোতা হতেই স্বাধীনতা পেয়ে গেল। স্বাধীনতার পর প্রথম স্বীকৃতিও কিন্তু ইসরাইল দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট আসিয়াসের প্রথম বিদেশ সফরও ইসরায়েলে।
-এই গরীব দেশে ইসরাঈল কী পাবে?

-অনেক কিছুই পাবে। ইরিত্রিয়ার অধীনে অনেক দ্বীপ পড়েছে। তার মধ্যে দুটি দ্বীপ ইতিমধ্যেই ইসরায়েলের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। একটাতে ইসরায়েল সামরিক বেস স্থাপনের কাজ শুরু করেছে আরেকটাতে চাষাবাদ। রাজধানী আসমারাকে ইতালিয়ানরা দ্বিতীয় রোম বলত। রোমের মত করেই গড়ে তুলেছিল তারা এ শহরকে। এখন সে রোম হয়েছে মোসাদের অভয়ারণ্য। মুসলমানদের মাদরাসাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ইতিমধেত্য প্রায় বিশ হাজারেরও বেশি মুসলিম স্কলারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আগে আরবী এখানকার প্রধান ভাষা ছিল। সব জায়গা থেকে আরবীকে হটিয়ে দেয়ার কাজ শুরু হয়েছে। ইরিত্রিয়া আফ্রিকা ও আরবের সংযোগসেতু। এটা দখলে রাখতে পারলে, অনেক লাভ। সামরিক ও অর্থনীতি ভূরাজনীতি সবদিক থেকে। ইসরাঈল এই লাভের প্রায় পুরোটাই নিজের পকেটে পুরতে সক্ষম হয়েছে।

আসমারা থেকে সোজা দাদুর কাছে চলে এলাম। দীর্ঘ প্রায় দেড় বছর পর দাদুর সাথে দেখা। জন্মের পর থেকে এত দীর্ঘ সময় কখনো দাদুকে ছেড়ে ছিলাম না। আদ্দিস আবাবায় থাকতেও না। আগে দাদুকে জানাইনি আমি আসছি। হঠাৎ করে জাজ¦ল্যমান আমাকে দেখে দাদু বাকহারা হয়ে গেলেন। দু’চোখের তারায় ফুটে উঠল ভীষণ খুশির ঝিলিক। এগিয়ে আসে হাত ধরলেন। দাদুকে কখনো মাত্রাতিরিক্ত আবেগ করতে দেখিনি। আজ একটু বেসামাল হয়ে গেলেন। বুঝতে পারলাম, তার প্রতি সত্যি সত্যি অন্যায় করে ফেলেছি। সবাইকে হারিয়ে ভীষণ একা হয়ে গেছিলেন, তারপর আমিও উধাও হয়ে গেলাম। দাদুর পুরো জীবনটাই এভাবে কেটেছে। অনেক কথা জমেছে! সবার আগে জানতে চাইলেন,
-জুমাইমা গিয়েছিল তোকে আনতে?
-জি¦।
-ও কি চলে কানাডা চলে গেছে?
-জি¦ না।
-কবে যাবে বলেছে কিছু?
-তাও বলেনি। ও আমার সাথে কথাই বলেনি। এটা রাগ না অভিমান নাকি অন্য কিছু বুঝতে পারিনি।
-পাগলি মেয়ে অভিমান করেছে। এভাবে কেউ হারিয়ে যায়? যাক, আমি খুশি হয়েছি, তুই অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে গিয়েছিস। লেখাপড়ায় দুই বছর পিছিয়ে পড়লি। এখন লেখাপড়ায় মন দে।
-আর লেখাপড়া মন বসবে? কতদিন হল বইখাতার সাথে সম্পর্ক নেই!
-এটা বুঝি একজন বুঝদার মানুষের কথা হল?
-কী পড়বো? কোথায় পড়বো?

-পরীক্ষার ফলাফল কেমন হয়েছে, সেটাও তো জানতে পারনি। আশাতীত ভাল করেছ। রাজধানিতে গিয়ে দেখ, কোথায় ভর্তি হওয়া যায়। তোমাকে যে কোনও মূল্যে ডাক্তার হতেই হবে। হারারে একজন মুসলিম ডাক্তার কত বেশি জরুরী, বলে বোঝানো যাবে না। তুই কয়েকদিন দেখ, তাহলে বুঝতে পারবি। একজন মহিলা ডাক্তারও প্রয়োজন। আমি জুমাইমাকেও বলেছি, ডাক্তারি পড়তে!
-সে ডাক্তারি পড়লে হারারের কী লাভ হবে?
-লাভ হবে কি হবে না, সেটা ভবিষ্যতে বোঝা যাবে। আল্লাহ তা‘আলার দরবারে অসম্ভব কিছু আছে? তিনি চাইলে দিনকে রাত করতে পারেন! তোর কাজ তুই কর, জুমাইমারটা আমি দেখব।
-আচ্ছা, আমি না থাকাবস্থায় সে নাকি গ্রীষ্মের ছুটি পুরোটাই তোমার এখানে কাটিয়েছে? কী করেছিল সে?
-কী করেনি? পড়েছে। পড়িয়েছে। আমার সাথে গল্প করেছে। কাজ করেছে। রুগিদের সেবা করেছে। চিকিৎসা করেছে।
-সে ডাক্তারি পারে?

-আমি শিখিয়ে দিয়েছি। সে থাকাতে অনেক উপকার হয়েছে। আমার মেয়েরা বেশ উৎসাহ পেয়েছে। তারা একজন শাদা মানুষের সাথে অকপটে মিশতে পেরে আনন্দিত হয়েছে।
-দাদু, একটা প্রশ্ন সব সময় মনের মধ্যে ঘুরপাক খেয়ে বেড়ায়। দাদাভাই মারা গেলেন, আগে ও পরে প্রায় সবাই চলে গেলেন, তোমার কষ্ট লাগে না?
-তুই আছিস, জুমাইমা আছে। এর বেশি আর কী চাই? আর কষ্ট? দেখছিস না কষ্টগুলো কিভাবে চোখের পানি হয়ে হু হু করে বেরিয়ে আসছে? তারা চলে গেছেন। তাই বলে জীবন কি থেমে থাকবে? সেই একদম দুধের বয়েস থেকেই তো একের পর এক হারিয়ে আসছি।
-দাদাভাইয়ের অভাব অনুভব করো না?

-এমন একটা মুহূর্তও নেই, তাকে অনুভব করিনি। তিনি আমার কাছে কী ছিলেন, বলে বোঝাতে পারব না। তিনি আমার শুধু স্বামী ছিলেন না। তিনি আমার বন্ধু ছিলেন, বাবার মতো ছিলেন, বড় ভাইয়ের মতো ছিলেন, পথ প্রদর্শকের মতো ছিলেন, শিক্ষকের মতো ছিলেন। তিনিই আমার প্রথম ও শেষ পুরুষ। সবচেয়ে বড় কথা আমি তার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলাকে পেয়েছি। ঈমান পেয়েছি। ইসলাম পেয়েছি। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পেয়েছি। কুরআন কারীম পেয়েছি। সেই সাতসমুদ্র তের নদী পেরিয়ে সুদূর আফ্রিকায় বাস করার হিম্মত পেয়েছি।

এক সপ্তাহ পরে আঙ্কল রোনে আমাকে আদ্দিস আবাবা যেতে বললেন। তিনি আসমারা থেকে সেখানে এসেছেন। তার সাথে দেখা করলাম। জুমাইমাও তার সাথে এসেছিল। এসে শুনি সে দাদুর সাথে দেখা করতে গেছে। আঙ্কল বললেন:
-আমি তিনদিনের জন্যে সরকারি এক কাজে এসের্ছি। আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি, এবছর আর মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার সময় নেই। মাত্র একমাস আগেই ভর্তি শেষ হয়েছে। ভাবলাম, এ-সময়টা বসে বসে নষ্ট না করে, কিছু একটা করো।
-কী করতে পারি?

-আমার মাথায় একটা পরিকল্পনা এসেছে। তুমি জানো কি না জানি না। ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সে পুরো কর্তৃত্ব ছিল আমেরিকার হাতে। ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত সব বিমান কেনা হয়েছে আমেরিকা থেকে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করছিলাম, ইথিওপিয়ার কাছে বিমান বিক্রি করতে। কিন্তু এয়ারলাইন্সের বড় বড় পদগুলোতে ছিল মার্কিন কর্মকর্তা। সত্তর দশকের মাঝামাঝিতে এসে বিমানসংস্থার নিয়ন্ত্রণ ইথিওপিয়ানদের হাতে আসে। এবার আমাদের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টা সফল হল। ১৯৭৫ সালে তাদের কাছে একটা বিমন বিক্রি করতে সক্ষম হই। সে থেকে শুরু। আজো অটুট আছে। দূতাবাসে আমার দায়িত্ব হল, বিমান ও পরিবহনের দিকটা দেখা। যাতে কানাডার তৈরী প্রডাক্ট ইথিওপিয়ার বাজারে জনপ্রিয় করে তোলা যায়। এরই প্রেক্ষিতে আমি কিছু প্রস্তাবনা দিয়েছি রাষ্ট্রদূত মহোদয়ের কাছে। তার মধ্যে একটা ছিল, আমার জন্যে একজন এদেশীয় প্রতিনিধি নিয়োগ করা। আমি তোমার নাম প্রস্তাব করেছি। তুমি কি কাজটা করবে?
-আপনি বললে করবো! তবে আমার ইচ্ছা ছিল, দাদুর সাথে থাকার!
-ভাল কথা। আমি চিন্তা করেছি, তুমি যদি পড়াশোনাটা কানাডাতে গিয়ে করতে, তাহলে ভাল হত। এই চাকুরিটা করলে, তোমার পড়াশোনার খরচা উঠে আসবে। আর কানাডা সরকারের অধীনে কাজ করার কারণে, ভিসা পাওয়াও সহজ হবে।
-আপনি আমার আর দাদুর জন্যে অনেক চিন্তা করেন। সেই কবে থেকে আপনার সাহায্যই পেয়ে আসছি। 

-তোমার এসব নিয়ে ভাবার প্রয়োজন নেই। তোমার জীবনে উন্নতি হোক, এটাই আমার কামনা। তোমার দাদু চান, তুমি একজন যোগ্য ডাক্তার হও। তোমার হারারের কল্যানের জন্যেই তিনিই এটা চান। অসহায় গরীব মানুষগুলোর চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্যে। তোমার দাদু আমাকে বারবার করে বলেছেন, আমি যেন তোমার লেখাপড়ার দিকটা দেখি।
-ঠিক আছে আঙ্কল, আমি চাকুরিটা করব।
-তাহলে তুমি গোছগাছ করে আগামী সপ্তাহে চলে আস। আমি সব ঠিকঠাক করে যাব। আর জুমাইমাকে সময়মত বিমানে তুলে দিও।

হারারে ফিরে এলাম। দাদু সারাক্ষণ জুমাইমাকে নিয়েই ব্যস্ত। আমার দিকে ফিরে তাকানোরও ফুরসত নেই। দেখতেই অবাক লাগছে, জুমাইমাকে দেখে মনেই হয় না, সে একজন খ্রিস্টান মেয়ে। দিব্যি দাদুর সাথে সব কাজে অংশ নিচ্ছে। ছায়ার মতো দাদুর সাথে লেপ্টে আছে। দাদু শুধু একবার জানতে চেয়েছেন, জুমাইমাকে তোর কেমন লাগে? আমি উত্তর দিলাম,
-সে ভালো মেয়ে। তাকে ভাল না লেগে উপায় নেই।
-সে চায় তোর সাথে থেকে যেতে!
-সে কি করে সম্ভব?
- বোকা ছেলে, সম্ভব করার দায়িত্ব আমার। আমি বলি কি, তুই একবার তার সাথে কথা বলে দেখ! ও তোর সম্পর্কে কী ভাবে জেনে নে!
-ঠিক বলেছ দাদু, জুমাইমার সাথে আমার একবার বসা দরকার। ওর আচরণগুলো দিনদিন রহস্যময় হয়ে উঠছে। সে যদি অন্যরকম কিছু ভাবে, তাহলে তার ও আমার উভয়ের সমস্যা। সে যদি সব সমস্যার কথা জানার পরও আগে বাড়তে চায়, আমার আপত্তি নেই।

দাদু জুমাইমাকে ডাকতে গেলেন। আমি বসে বসে ভাবতে লাগলাম। জীবন নিয়ে কত কি ভেবে ভেবে হয়রান ছিলাম, এখন জীবন বইছে কোন খাতে। আমার জীবনের লাগাম আমার হাতে নেই। ময়দানে থাকতে কল্পনা করতাম, আর কখনো বের হবো না, শহীদ হওয়া পর্যন্ত একটানা আল্লাহর রাস্তায় লেগেই থাকব। শহীদ হওয়ার আশায় ইরিত্রিয়া স্বাধীন হওয়ার পর মাটি কামড়ে পড়ে রইলাম। কিন্তু কুদরতের ফয়সালা ছিল ভিন্ন। আল্লাহ তা‘আলা হয়তো অন্যভাবে কাজ নেয়ার ফয়সালা করে রেখেছেন। আচ্ছা, আমি কি ময়দান ছেড়ে পালিয়ে এসেছি? নাহ, তা কি করে হয়। আমাদের পিছিয়ে আসা ছাড়া অন্য কোনও উপায় ছিল না। অস্ত্র নেই, খাবার নেই, সামনে শত্রুও নেই। এমতাবস্থায় কিভাবে যুদ্ধ করি? কার সাথে করি? আর পিছিয়ে আসা হয়েছে, সর্বসম্মত পরামর্শক্রমে। এটা নিয়ে মনে কোনও ধরনের গ্লানি থাকা উচিত নয়। 

আমার এখন হারারকে নিয়ে ভাবতে হবে। এখানকার শিক্ষা, চিকিৎসা, মূল্যবোধ নিয়ে। কিভাবে হারারকে আদ্দিসআবাবার খ্রিস্টান বলয় থেকে বের করে, আগের নিষ্কলুষ ইসলামি ভাবধারায় ফিরিয়ে আনা যায়, তার জন্যে কাজ করতে হবে। যেসব মেয়েরা হারার ছেড়ে চলে গেছে, জীবিকার নাম করে, তাদেরকে ঘরে ফেরানোর যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। এখানেই তাদের জন্যে সম্মানজনক আর্থিক বন্দোবস্তি করতে হবে। তাদেরকে আগের মতো শিক্ষাব্রতী করে তুলতে হবে। এখানেই একটা মেডিকেল কলেজ স্থাপনের চেষ্টা করতে হবে। দাদু থাকতে থাকতে, দাদুর গড়ে তোলা ছাত্রীদেরকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে দিতে হবে। তারা যেন প্রত্যেকে সুগৃহিনী হতে পারে, তার জন্যে উপযুক্ত পাত্র দেখে বিয়ে দিতে হবে। এমন সুযোগ্য পাত্রীদের যারা পাত্র হবে, তারাও যেন কিছুটা যোগ্যতা অর্জন করে সংসারধর্ম শুরু করতে পারে, তার উদ্যোগ নিতে হবে। কত কাজ! আরে বসে বসে ভাবছি, দাদু এলেন না যে এখনো? জুমাইমা আসতে রাজি হচ্ছে না? কথা বলতে আগ্রহী নয়?
-দাদুউউউ! ও দাদুউউ!

-এই তো আসছি! জুমাইমা এইমাত্র স্কুল থেকে ফিরল। ভীষণ ক্লান্ত। এ-অবস্থায় তোর সাথে বসতে লজ্জা পাচ্ছে। আর এখন মানসিকভাবে প্রস্তুত নয় বলছে।
-আচ্ছা, ঠিক আছে। তুমিই কিন্তু আগে বেড়ে উৎসাহ দেখাচ্ছ। পরে ভিন্ন কিছু হলে আমার দোষ নেই।
-তুই একটা বুদ্ধু! জুমাইমার মতো একটা মেয়ে বুঝি আমার মতো বুড়ির কাছে থাকতে আসে? হোক না বয়েস কম, তুই ওর সাথে কখনো কথা বলে দেখলে বুঝতে পারবি, বয়েসের তুলনাত সে কতটা অগ্রসর! তার ভাগ্যটা আসলেই ভাল। অত্যন্ত ভাল বাবা-মা পেয়েছে। তারপর শিক্ষক হিশেবে পেল তোকে।
-আমি তাকে আর কিইবা শিখিয়েছি! সেই উল্টো আমাকে শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছে। 

-নাহ, সে তোর কাছেই প্রথম শালীনতা শিখেছে। চলাফেরায় পরিমিতিবোধ শিখেছে। বাবামাকে শ্রদ্ধা করার শিক্ষা পেয়েছে। সেই ছোট বয়েসেই নিজেকে রেখেঢেকে রাখতে শিখেছে। অপ্রয়োজনে সময় নষ্ট না করে, মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করতে শিখেছে। স্কুলে পেয়েছে সুদানী বান্ধবী। তার প্রভাবও জুমাইমার জীবনে অনস্বীকার্য। কানাডায় পেয়েছে এক পাকিস্তানি শিক্ষিকা। সবমিলিয়ে আল্লাহ তা‘আলা তার প্রতি খাস রহমত নাযিল করেছেন। আমি প্রথম দিন ওর সাথে কথা বলেই বুঝতে পেরেছিলাম, সে আর দশজন ইউরোপিয়ান মেয়ের মতো নয়। তাদের মতো হলে, সে তোকে ও আমাকে সান্ত¡না দেয়ার জন্যে এতদূর ছুটে আসত না। ওর সাথে কথা বললে, সে তোকে জানাবে। আমি সব জানিয়ে দিলে, পরের মজা নষ্ট হয়ে যাবে। 

-দাদু, আমি পরীক্ষার পর না আসাতে তুমি কিভাবে ওর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেছিলে?
-আমি করিনি। সেই অগ্রণী হয়ে আমার সাথে যোগাযোগ করেছিল। সে চিঠি লিখেছিল তার বাবার কাছে। তার বাবা আমার কাছে পাঠিয়েছে। আমি মনে মনে তার সঙ্গ কামনা করছিলাম। এমন সময় তার চিঠি হাতে পেয়েছিলাম। তারপর থেকে আমিও লিখেছি সেও লিখেছে। চিঠির মাধ্যমে দু’জনের মধ্যে একটা অসম বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। তাকে চিঠি লেখাটা নেশার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তোকে চিঠিগুলো দেখাব। সে আমাকে লিখত সে কী পড়ছে, কি শিখছে, কি জানছে, কি দেখছে, কি ভাবছে! আমি তাকে লিখে জানাতাম কি শিখেছি শিখছি, কি ভেবেছি ভাবছি, কি জেনেছি জানছি, কি দেখেছি দেখছি! আমার চিঠিগুলো পড়ে ও যেমন অনেক কিছু জানতে পারতো, আমিও তার চিঠি পড়ে অনেক কিছু জানতে পারতাম। শিখতে পারতাম। উন্মুক্ত পৃথিবীর সন্ধান পেতাম। এমনকি তোদের সংবাদও পেতাম তার কাছ থেকে!
-আমাদের সংবাদ? কিভাবে?

-আমি তাকে চিঠিতে জানিয়েছিলাম, তুই ইরিত্রিয়া গিয়েছিস। ইথিওপিয়ার জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে! বিশ^াস করবি না, জুমাইমা ব্যাপারটাতে এত বেশি মুগ্ধ হয়েছিল, পারলে সেও তৎক্ষণাত তোর সাথে যোগ দেয়ার জন্যে ইরিত্রিয়া চলে যায় যায় অবস্থা। সে বাবার মাধ্যমে ও এক মহিলা সাংবাদিকের মাধ্যমে নিয়মিত ইরিত্রিয়ার সংবাদ রাখতে শুরু করল। যা জানত, সাথে সাথে আমাকে লিখে জানাত। কানাডার এক পত্রিকায় সে নিয়মিত ইরিত্রিয়া বিষয়ক লিখতেও শুরু করেছিল ছদ্মনামে। ওটা নিয়েও মজার ঘটনা। সম্পাদক ভেবেছিল বড় বয়েসের কেউ লিখছে। পরে খোঁজ নিয়ে আসল মানুষের হদিস উদ্ধার করে তো তারা থ’। এই মেয়ে এত দূরদৃষ্টি কিভাবে পেল? কোথায় কানাডায় বসে সুদূর ইরিত্রিয়ার ফ্রন্টলাইনের তরতাজা খবর সংগ্রহ করছে। আবার ব্যক্তিগত বিশ্লেষণও দিচ্ছে! 

তুই ময়দানে থাকাবস্থায় সে বেড়াতে এসেছিল। ইরিত্রিয়ায়। সেই মহিলা সাংবাদিকের সাথে সে ফ্রন্ট লাইনেও চলে গিয়েছিল। চুরি করে। বাবা-মায়ের অগোচরে। কেন গিয়েছিল বুঝতেই পারছিস। তোকে খোঁজার জন্যে। যদিও বাবা-মাকে বলেছে, সে ভবিষ্যতে ডাক্তারি পেশার পাশাপাশি শখের সাংবাদিক হবে, তাই একজন অভিজ্ঞ সাংবাদিকের সাথে হাতেকলমে শিখতে গিয়েছে। সে মহিলা সাংবাদিকও টের পায়নি জুমাইমা তার সাথে সাথে এতদূর গিয়েছে।
-এ তো ভীষণ দস্যি মেয়ে দেখছি! 

-এ আর দস্যিপনার কি দেখছি! ও যেসব দুঃসাহসিক ভাবনা ভাবে, সেসব জানতে পারলে, আমার মনে হয় তুই তার ত্রিসীমানায়ও ঘেঁষতে চাইবি না। তার মা আমার কাছে আক্ষেপ করে বলেছে, তার মেয়েটা কেন যে এমন বেয়াড়া হয়ে বেড়ে উঠল! ডরভয় কিছুই নেই। তবে বেয়াদব নয়। মায়ের কথা মন দিয়ে চুপটি করে শোনে। কোনও বিষয়ে মায়ের সাথে একমত হতে না পারলে, ঠা-া মাথায় যুক্তি দিয়ে মাকে নিজের মতে এনে ছাড়ে। মেয়ের উসীলায় বাবা ও মা উভয়েই এখন হেদায়াতের প্রায় কাছাকাছি। আগে জুমাইমার মা বোধ হয় আমাদেরকে পছন্দ করতো না, কিন্তু মেয়েকে দিনদিন ভালো হতে দেখে, মাও আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এখানে এসে থেকে গেছে। আমাদের স্কুলে শ্রম দিয়ে গেছে। ছাত্রীদের সাথে সময় কাটিয়ে গেছে। আমাদের স্কুলের মেয়েদের সাথে সময় কাটালে, যে কারও ভাল লাগবে।
-দাদু, আমি জুমাইমার সাথে এখন আর বসতে চাই না।
-কেন?
-আগে আঙ্কলের মতামতটা জেনে নিই। তারপর।
-সেটা নিয়ে তোর ভাবতে হবে না। কানাডার বিয়ের বয়েস আঠার। তার অপেক্ষায় আছি। সময় হলে আমি প্রস্তাব দেব। রাজি না হলে, তখন দেখা যাবে। অবশ্য বিশেষ ব্যবস্থায় ষোল হলেও নাকি বিয়ের একটা ব্যবস্থা কানাডার আইনে আছে।
-সেটা কাগজেকলমে বিয়ের বয়েস। এটা সম্পূর্ণ ইসলাম বিরোধী আইন।
-আচ্ছা, আমি জুমাইমার সাথে কথা বলে দেখি।
দু’জনে মুখোমুখি বসা আর হয়ে উঠল না। জুমাইমা চলে গেল। আমি আর দাদু আবার একা। চাকুরিতে যোগ দেয়ার সময় হল। আদ্দিসআবাবায় চলে এলাম। শুরু হল আমার চাকুরে জীবন। বেশিদিন চাকুরি কপালে ছিল না। সমস্যা দেখা দিল সম্পূর্ণ ভিন্ন দিক থেকে। চাকুরির তৃতীয় মাসে, আঙ্কল রোনে আদ্দিস আবাবায় এলেন। আমাকে ডেকে বললেন:
-ইথিওপিয়ার সরকার একটা তালিকা তৈরী করছে গোপনে।
-কিসের তালিকা?

-ইথিওপিয়া থেকে কারা কারা ইরিত্রিয়ার পক্ষে যুদ্ধ করেছে তাদের তালিকা।
-খুব সম্ভব তোমার নামও তালিকায় আছে। আমি জানতে পেরেছি এক জেনারেলের সূত্র ধরে। তিনি আমাদের কানাডার পক্ষে কাজ করেন। এখানকার সরকার যেন কানাডার বিমান ও পণ্য কেনে, এ-বিষয়ে লবিং করার দায়িত্ব তার। তালিকাটা চূড়ান্ত হতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে। বেশি সময় পাওয়া যাবে না।
-আমি এখন কী করতে পারি?
-বেঁচে থাকতে চাইলে খুব দ্রুত দেশত্যাগ করতে হবে।
-কিন্তু কোথায় যাব? ইরিত্রিয়া বা সুদান?
-ওদিকে গেলে সমস্যা দেখা দেবে! ভবিষ্যতে আর আইনসঙ্গতভাবে দেশে ঢুকতে পারবে না। তুমি খুব দ্রুত পাসপোর্ট করে ফেল।

বিমানে ওঠার আগেও ভাবতে পারিনি, শেষ পর্যন্ত আকাশে উড়তে পারব। বিমান যতক্ষন মাটিতে ছিল, ভয়ে ভয়ে ছিলাম, এই বুঝি ধরতে এল। এই বুঝি ফ্লাইট বাতিলের ঘোষণা এল। না, সেসবের কিছুই ঘটল না। বিমান নিরাপদেই আকাশে উড়াল দিল। বিমান এগিয়ে যাচ্ছে অসীম আকাশের দিকে। আমি এগিয়ে যাচ্ছি একটি সসীম স্বপ্নময় জীবনের দিকে। জুমাইমার মতো একটা মেয়েকে সাথে পেলে দুনিয়া জয় করে ফেলতে পারব। ইনশাআল্লাহ। এত সহজে দু’জন কাছাকাছি আসার সুযোগ পাব, কল্পনাতেও আসেনি। তাকে কাছে পাওয়ার জন্যে, নিজের জীবনসঙ্গী করে ঘরে তোলার জন্যে কতভাবে পরিকল্পনা সাজিয়েছি, কিন্তু কোনওটাই শেষ পর্যন্ত যুক্তিসঙ্গত মনে হত না। ছুঁড়ে ফেলে নতুন আরেক পরিকল্পনায় ডুবে যেতাম।
সেদিন আঙ্কলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, দ্রুত পাসপোর্ট অফিসে গেলাম। সাথে কানাডা দূতাবাসের সুপারিশ থাকাতে সবকিছু দ্রুত হয়ে গেল। সেই জেনারেলই আড়াল থেকে কলকাঠি নেড়ে যাবতীয় মুস্কিল আসান করে দিয়েছেন। পাসপোর্ট হওয়ার পর আঙ্কল আমাকে নিয়ে সোজা দাদুর কাছে গেলেন। তিনজন মিলে বৈঠকে বসলাম। দাদু সব জেনে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন।
- এখন কী হবে? আমাদের হারারের ভবিষ্যত পরিকল্পনার কী হবে?
-আপনি চিন্তা করবেন না। আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। ওকে কিছুদিনের জন্যে কানাডা পাঠিয়ে দিতে চাই! আপনার আপত্তি আছে?

-আমার কেন আপত্তি থাকবে? আগে পরে সে ডাক্তারি পড়ার জন্যে কানাডায় যাওয়ার কথাই ছিল।
-কিন্তু তার যাওয়াটা স্বাভাবিক হচ্ছে না। ধরপাকড় শুরু হলে, সে আর কখনো দেশে ফিরে আসতে পারবে না। আবার আমি তাকে কয়েক মাসের টুরিস্ট ভিসা সংগ্রহ করে দিতে পারব। কানাডা চলে যাওয়ার পর, চেষ্টা-তদ্বির করে কাজ করার অনুমতিও আদায় করে দিতে পারব! কিন্তু এদেশের সামরিক সরকার যদি কানাডা সরকারের কাছে আবেদন করে, আমাদের সরকার নিজেদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে, বিলালকে ইথিওপিয়ান কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেবে। এটা ঠেকানোর উপায় আমার জানা নেই। একটা উপায় হতে পারে, সে গোপনে আমেরিকা পালিয়ে গেল। কিন্তু হারার নিয়ে তার ভবিষ্যত পরিকল্পনা? এখানকার মানুষগুলো নিয়ে তার এতদিনের স্বপ্ন? সবই যে ব্যর্থ হয়ে যাবে?
-তাহলে উপায় কি?

-একটা উপায় অবশ্য আছে। তাকে কোনও উপায়ে কানাডার নাগরিকত্ব পাইয়ে দেয়া। কিন্তু এটা এত অল্প সময়ে সম্ভব নয়। অল্প সময়ে নাগরিকত্ব পেতে হলে ওখানকার কোনও মেয়েকে বিয়ে করতে হবে।
আঙ্কল কথা থামাতেই দাদু বললেন:
-রোনে, তুমি আমার একমাত্র নাতিকে বাঁচানোর জন্যে বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারবে না?
-কেন পারব না। অবশ্যই পারব।
-আমি যদি বলি, জুমাইমাকে আমরা পাত্রী হিশেবে চাই, তুমি কি রাগ করবে?
-কী বলছেন আপনি। আমরাও তাই চাই। জুমাইমার আম্মু আগে রাজি ছিল না। এখন আপনি জানেন, সেও আপনাকে অত্যন্ত পছন্দ করে।
-আলহামদুলিল্লাহ। আমার বুক থেকে বিরাট এক পাষাণ নেমে গেছে।

বিমান চলছে। আমিও চলছি। বিমান এগুচ্ছে তার গন্তব্যের দিকে। আমি এগুচ্ছি হৃদয়নোঙ্গরের দিকে। ভবিষ্যত পরিকল্পনাগুলো একে একে ভেসে উঠতে থাকল। দু’জনেই ডাক্তারি পড়লেও দু’জনের পড়ার বিষয় ভিন্ন হবে। সে মনোযোগ দেবে নারী বিষয়ক সমস্যাগুলোর দিকে। দু’জনে মিলে হারারকে গড়ে তুলব একটি সুন্দর জনপদে। আমাদের সন্তানরা বেড়ে উঠবে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকময় সমাজে। ইনশাআল্লাহ।

Wednesday, 25 October 2017

প্রযুক্তির উতকর্ষের যুগে মানুষ বন্দী হয়েছে প্রযুক্তির হাতেই। আটকা পড়েছে মাকড়শার জালের মতো ছড়িয়ে থাকা অন্তর্জালে। পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয়। পৃথিবীর এক কোনের নিউজ পৌঁছে যাচ্ছে অপর কোনে মুহূর্তেই। বন্ধুত্ব হচ্ছে চেনা অচেনা জানা অজানা বন্ধুদের সাথে।

সাকিব মুসতানসির
আলেম ও বস্ত্র প্রকৌশলী

দিনের বড় একটা সময় মানুষ কাটাচ্ছে প্রযুক্তির নানাবিধ ব্যবহারে 
বিশেষ করে কিশোর ও তরুণ সমাজ। আটকা পড়েছে ফেসবুক,
 ইউটিউব, টুইটার, টেলিগ্রাম, ভাইবার, হোয়াটএপের মতো বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ 
সাইটগুলোতে।
ফলো, আপলোড, স্ট্যাটাস, লাইক-কমেন্ট, শেয়ারিং ম্যাসেজিং ইত্যাদি 
বর্তমানের কিশোর তরুণ থেকে শুরু করে মাঝ বয়েসি বেশ বড় সংখ্যক মানুষের 
নিত্য কর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মানুষ যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন মানুষের সাথে। ফলে, যেমন বাড়ছে সামাজিক যোগাযোগ 
তেমনি একই হারে কমছে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, আদব লেহাজ, সম্মান স্নেহ।
বয়স ও সময়ের বাঁধনকে অতিক্রম করে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে কিশোর তরুণ
 যুবক সবাই মেতে উঠছে অযাচিত আক্রমণ, অসংলগ্ন কথাবার্তা, 
অহেতুক তর্কবিতর্ক, হিংসা-দ্বেষ ও গীবত-পরনিন্দায়।

বড় ছোট, ছাত্র শিক্ষক, আত্মীয়তার সম্পর্ক সব কিছুই খেলো হয়ে যাচ্ছে এই অন্তর্জালে এসে!
এখানে সবাই নিজের প্রোফাইল ও স্ট্যাটাস আপডেট করতে এতোটাই মেতে থাকছি যে তার 
আচার আচরণ যে অন্য সদস্যদের কষ্টের কারণ হচ্ছে তা আমরা বুঝতেই পারছি না।

মুরুব্বীদের নির্দ্বিধায় কটাক্ষ করছি, সম্মানিতদের নিয়ে হাস্যরস করছি, 
বড়দের সাথে বেয়াদবি করছি, পরস্পরে পরনিন্দা চুগোলখুরি গালাগালি করছি, স্ল্যাং ল্যাঙ্গুয়েযে 
কথা বলছি, অযাচিত ছবি ভিডিও আপলোড করে মানুষের সামাজিক সম্ভ্রমহানি করছি 
প্রতিনিয়ত!

অন্তর্জালের এই স্বভাব সহজেই আমাদের কিশোর তরুণদের দৈনন্দিন কার্যকলাপের মাঝেও 
ব্যাপকহারে পরিলক্ষিত হচ্ছে ফলে পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে প্রতিনিয়ত। 
ছেলে-মেয়েরা হয়ে পড়ছে খিটখিটে মেজাজের! অল্পতেই উত্তেজিত হয়ে পড়ছে।
সহজ সাধারণ বিষয়েও পরস্পর ঝগড়ায় লিপ্ত হচ্ছে, তর্কে জড়াচ্ছে সম্মানিত ও
 বড়দের সাথে, নষ্ট হচ্ছে সামাজিক বন্ধন, ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে পরিবার ও আত্মীয়তার সম্পর্ক।
এখন সময় হয়েছে সব কিছুর লাগাম টেনে ধরার। একটা নিয়মের বন্ধনে সকলকে 
আবদ্ধ করার। আমাদের সুন্দর সমাজ পরিবারকে আমরা ধ্বংস হতে দিতে পারিনা 
তাই আসুন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যাবহার করতে মেনে চলি কিছু নিয়ম কানুন-

অনলাইনে যোগাযোগের আদব

১. ভদ্র ও নম্র্ভাবে স্ট্যাটাস কমেন্ট করা। আপনার কথায় লেখায় আপনার ব্যাক্তিত্ব 
ফোটে উঠে তাই প্রতিটা শব্দ যেন ভেবে-চিন্তে লিখা হয় সেদিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখা।
২. সত্য কথা বলা ও লেখা । ভুল ও উল্টা-পাল্টা তথ্য দেয়া সামাজিক যোগাযোগ 
সাইটগুলোর সদস্যদের অন্যতম অভ্যাস ! ফলে অধিকাংশ সময় মানুষ বিভ্রান্ত হয়।
৩. উত্তম কথা বলা ও লেখা । সকল কল্যাণ নিহিত আছে এতে।
৪. ধীর-স্থিরভাবে স্পষ্ট করে কথা বলা ও লেখা। বুদ্ধিমানরা তাই করে। 
তাড়াহুড়া করতে গেলে সব সময় নিজেকেই ক্ষতিগ্রস্থ ও বিব্রত হতে হয়।
৫. কথা লাগানোর অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে । এক জায়গার কথা অন্য জায়গায় লাগানোর
 অভ্যাস ঝগড়া লাগাতে সাহায্য করে।
৬. নিজের ওজন বুঝে কথা বলা । ইচড়েপাকা আর বেয়াদবি মার্কা কমেন্ট করা আমাদের স্বভাব 
হয়েগেছে।অনেক সময় দেখা যায় হিফজ পড়া ছেলেও মুফতি সাহেবের সাথে কথা কাটাকাটি 
করছে!!
নিজের শিক্ষা, যোগ্যতা ও উপযুক্ততা বুঝে পাশাপাশি অপরের যোগ্যতা সামাজিক 
মর্জাদা মাথায় রেখে পোস্টে প্রতিক্রিয়া দেখাতে হবে ।
৭. বেশি কথা বলার পরিণতি সব সময় খারাপ হয় ।
৮. অনর্থক কথা বলা ও লিখা থেকে বিরত থাকতে হবে । 
অনর্থক কথার কারনেই অনেতুক বাকবিতান্ডার সৃষ্টি হয় যার শেষ হয় পারস্পরিক সম্পর্ক 
নষ্টের মাধ্যমে ।
৯. নিজের কথা ও চিন্তা-ভাবনাকেই সঠিক মনে না করা । সকল সমস্যার মূলে এটাই ।
১০. অহেতুক তর্ক না করা । যেখানে আরো বিস্তারিত জানার বা 
শিখার আছে সেখানেই যৌক্তিক ও দালিলিক তর্ক করা ইনসাফের সাথে।
১১. অশ্লীল স্ট্যাটাস, ছবি, ভিডিও আপলোড ও কমেন্ট না করা ।
১২. আক্রমনাত্বক কমেন্ট/ স্ট্যটাস এড়িয়ে চলা ।
১৩. কোন বিষয় নিয়ে হাসি ঠাট্রায় মেতে না উঠা । 
ব্যাক্তিকে ও সমষ্টিকে নিয়ে হাসিঠাট্টায় মেতে উঠা অসুস্থতার লক্ষণ। 
এথেকে বেঁচে থাকা জরুরী। এসব কারণে সম্মানিত মানুষের অসম্মান হয়। 
পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট হয়।
১৪. গীবত-পরনিন্দা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলোতে মহামারী আকার ধারণ করেছে 
অথচ গীবতকারী হাদিসের ধমকিতে আছেন তা আমরা ভুলেই যাই ।
১৫. অন্যের সম্মানহানী হয় এমন স্ট্যটাস ও কমেন্ট থেকে নিজেকে বিরত রাখা ।
 মানুষের সম্মানটাও একটা বড় আমানত।
১৬. কোন তথ্য যাচাই না করে সত্য মেনে না নেয়া।সামাজিক মাধ্যমগুলোতে প্রচুর 
ফেক আইডি রয়েছে যাঁদের কাজ হচ্ছে প্রতিনিয়ত বিভ্রান্তিকর তথ্য আপলোড করা।

আমাদের সতর্ক থাকতে হবে এবং বিশ্বস্ত মাধ্যমে প্রতিটা তথ্য যাচাই-বাছাই করে তবেই বিশ্বাস করতে হবে।

writer atikullah- রেসিডেন্সিয়াল গার্লসস্কুল ইন হারার story part-2



-

অপ্রত্যাশিত মেহমান দেখে দাদু শশব্যস্ত হয়ে অভ্যর্থনা জানালেন। জুমাইমাকে তিনি আগে দেখা তো দূরের কথা, তার নামও শোনেননি। আমি পরিচয় করিয়ে দিলাম। দাদু পরম আদরে তাকে কাছে টেনে বসালেন। আমি আঙ্কল রোনেকে বৈঠকখানায় বসালাম। আঙ্কল জানালেন, বেশিক্ষণ থাকতে পারবেন না। চলে যাবেন। দাদুর পীড়াপীড়িতে একবেলা খেয়ে যেতে রাজি হলেন। 



.চটজলদি যোগাড়যন্ত্রে নেমে পড়লাম। আঙ্কলের সাথে সবার জন্যে আরও কয়েকজনকেও নিমন্ত্রণ করলেন দাদু। আমি বাইরের কাজে দৌড়াদৌড়ি করছিলাম। দাদু ঘরের কাজ একা একা সামাল দিচ্ছেন দেখে, জুমাইমাও সাথে জুড়ে গেল। সে এসব কাজ আগে করেছে কি না, জানি না। তবে বেশ ভালোভাবেই দাদুর সাথে মিশে গেল। দেখে মনে হচ্ছিল, সে কতদিনের আপন! বাইরের কেউ নয়! .


রাতের গাড়িতে আঙ্কল চলে যাবেন বলে ঠিক করলেন। জুমাইমা আব্দার জুড়ল, সে দাদুর কাছে আরও কয়েকটা দিন থেকে যাবে! দাদু ভীষণ খুশি! 

অল্প কয়েকটা ঘণ্টার সঙ্গেই নিজের দেশি মেয়েটাকে বড্ড ভাল লেগে গেছে। দীর্ঘদিন পর, এই প্রথম তিনি বাপের বাড়ির দেশের কারো দেখা পেলেন। মন খুলে ইংরেজিতে কথা বলতে পারলেন। জুমাইমা প্রথমে দাদুকে দেখে আকাশ থেকে পড়েছিল! সে ভেবেছিল আমার দাদুও একজন কালো মানুষই হবেন।

জুমাইমার সাথে আমার দেখা হয়েছিল আদ্দিস আবাবায় যাওয়ার পর। তখন সে মাধ্যমিকে পড়ে। তাকে পড়ানোর দায়িত্বও পালন করতে হয়েছিল। তারপর সে কানাডা চলে গিয়েছিল। আদ্দিস আবাবায় জুমাইমা পড়তো বিদেশী দূতাবাসগুলোর জন্যে নির্দিষ্ট এক দামী স্কুলে। 

আঙ্কল রোনের বাড়িতে থাকতে শুরু করার কিছুদিন পর, আন্টি একদিন আমাকে বললেন, তার মেয়েকে পড়ার কাজে একটু সহযোগিতা করতে। ভয়ে ভয়ে রাজি হলাম। আমি তাকে পড়াব কি, সেই উল্টো আমাকে পড়াতে শুরু করল। আমি পড়েছি প্রাচীন শিক্ষারীতিতে আর সে পড়ছে বিশ্বের সর্বাধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায়। বয়েসে আমার চেয়ে সে অনেক ছোট, তবুও বিভিন্ন বিষয়ে তার অবাধ জানাশোনা আমাকে রীতিমতো নির্বাক করে দিত। আমার মাঝেমধ্যে মনে হত, জুমাইমাকে পড়ানোর দায়িত্ব দেয়ার পেছনে আঙ্কল-আন্টির অন্য একটা উদ্দেশ্য কাজ করেছিল।


 আমি তাদের বাড়িতে থাকতাম, এর বিনিময়ে তারা কিছুই গ্রহণ করতেন না। কিন্তু এটা নিয়ে আমার মনে গ্লানিবোধ জন্মাতে পারে, সেটা দূর করার জন্যেই এ-ব্যবস্থা। পাশাপাশি এটাও বিচিত্র নয়, মেয়েকে পড়াতে গেলে হয়তো আমারও মৌলিক যোগ্যতায় কিছুটা উন্নতি হবে, তাই এ-সুযোগ। জুমাইমা ছিল অত্যন্ত ডানপিটে। 

আন্টি প্রায়ই বলতেন, তোমাকে দেখে যদি ও একটু শান্তশিষ্ট হতে শেখে, সেটা হবে ও জীবনের অনেক বড় পাওনা। মেয়েটা কথা শুনতে চায় না। চার্চে যেতে চায় না। 

তুমি ওকে বুঝিয়ে বলো একটু! 

আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করতাম,-আমি কিভাবে ওকে চার্চে যেতে উদ্বুদ্ধ করবো? আমি নিজেই তো চার্চে যাই না?

-না গেলেও, ও তোমার ব্যাপারে ভীষণ আগ্রহী! তুমি কিছু মনে করো না, সে ইথিওপিয়ায় থাকলেও, তাদের স্কুলের সবাই ইউরোপিয়ান। তোমার আগে, আফ্রিকান কাউকে সে এত কাছ থেকে দেখার সুযোগ পায় নি। সে চঞ্চলমতি হলেও তার মধ্যে একটা ভাবুক মন আছে! বয়েস কম হলেও সে অনেক কিছু ভাবতে র্শিখেছে! -ঠিক আছে, আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব!আমার চেষ্টা কতটুকু সফল হয়েছিল জানি না, তবে আমি টের পেতাম, বাবা-মায়ের চেয়েও আমার সাথে কথা বলতে সে বেশি আগ্রহী ছিল। স্কুলের অনেক কথা সে মাকে বলার আগে আমাকে বলত। আমিও তার কথা শুনে বেশ মজা পেতাম।


 ইউরোপিয়ানদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারতাম। বর্তমানের ছেলেমেয়েদের ভাবনাচিন্তা কেমন, সেটার গতিপ্রকৃতি আঁচ করতে পারতাম! বছরখানেক পরেই সে কানাডা চলে গিয়েছিল। দীর্ঘদিন পর আজ দেখা। প্রায় চার বছর পর। সেদিনের ছোট্ট খুকি কতবড় হয়ে গিয়েছে। 

.আঙ্কল চলে যাওয়ার পর, গল্পের আসর বসল। 

জুমাইমার কৌতূহল আর বাধ মানছে না। তার দেশের একটা মানুষ আফ্রিকার এই সুদূরে কিভাবে এলেন? 

নিশ্চয় বড় কোনও ইতিহাস এর পেছনে লুকিয়ে আছে। 

দাদু তাঁর হাতের কাজ গুছিয়ে এসে বসলেন। জুমাইমাকে কী একটা মিষ্টি খেতে দিলেন। মিষ্টান্ন দ্রব্যটা শুধু হারারেই পাওয়া যায় না। 

এখানকার কফি বিশ^বিখ্যাত। কফিবিন মিশিয়ে কিভাবে যেন বানানো হয়। অনেক মহিলা এটা বানিয়েই জীবিকা নির্বাহ করে! 

দাদু আসার পর, সুলিয়া মানে মিষ্টান্য দ্রব্যটির আকারে ও প্রকারে, গুণে ও মানে অনেক পরিবর্তন এসেছে! তিনি মেধা খাটিয়ে সুলিয়াকে নতুন রূপ দান করেছেন। আগে শুধু বড়রাই খেতে পারত! এখন বড়রা তো বটেই ছোটরাও সুলিয়ার জন্যে পাগল! জুমাইমা সুলিয়া মুখে দিয়ে স্বাদের আস্বাদনে চোখ বুজে ফেলল! সেটা দেখে দাদুর চোখে পরম আদরমাখা দৃষ্টি ফুটে উঠল! তিনি বলে উঠলেন:-তোমাকে আজ একটা সুলিয়া দিয়েছি! প্রথমবারে একটার বেশি খাওয়া ঠিক নয়। আগামী কাল আরও দেব! এটা খেলে একটু ঘুম ঘুম ভাব আসে! অবশ্য একটু পর কেটে যায়! 

-এবার আপনার ঝাঁপি খুলুন দাদু! আমার আর তর সইছে না! 
-কিভাবে যে খুলি, খুললেই সে মানুষটার কথা মনে পড়বে! এতদিনের ভালোবাসা ভুলি কী করে? 

তিনি আমার শরীরের একটা অংশে পরিণত হয়েছিলেন! আমার মন বা আত্মা বলেও আলাদা কিছু আছে, তার থাকাবস্থায় সেটা অনুভব করতে পারিনি! তিনি আর আমি এক দেহ এক আত্মার মতো ছিলাম! আমার কথা মানেই তার কথা! বিলালের দাদুর কথা! তিনি জীবনে এত এত সংগ্রাম করেছেন, আমি তুমি কল্পনাও করতে পারব না! 

এখন যে ঘরে বসে আমরা কথা বলছি, এ-ঘরেই আমার শাশুড়ি থাকতেন! তিনি তার সন্তানদের নিয়ে ঘুমুতেন! তার পূর্বপুরুষ ছিল হারারের রাজা। তারা আরব থেকে এখানে এসে শত বছর হারারকে শাসন করেছেন। 

আফ্রিকা মহাদেশকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। 

এখন ইথিওপিয়ার যে রাজধানি, সেটাও তাদের রাজত্বের অধীনে ছিল! কিন্তু ইউরোপিয়ানদের আগ্রাসনে সে রাজপাট একসময় বিলুপ্ত হয়ে গেছে! ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছিল রাজবংশের লোকেরা। 
.বিলালের দাদু তখন সদ্য কৈশোর পেরুনো টগবগে তরুণ। ইতালির সরকার ইথিওপিয়া আক্রমণ করে। এটা ১৯৩৫ সালের ঘটনা। 

আদ্দিস আবাবায় তখন খ্রিস্টান সরকার। তারা সারা দেশের মানুষকে ইতালিয়ান হানাদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানায়। বেনিতো মুসোলিনির সা¤্রাজ্যবাদী চিন্তা আফ্রিকার গহীন পর্যন্ত এসে পৌঁছল। হারার থেকে একদল মুসলিমও ইতালিবিরোধী সংগ্রামে যোগ দিয়েছিল। তাদের মধ্যে ছিল বিলালের দাদা। মুসোলিনি এখানে তার সর্বশক্তি ব্যয় করেছিল। আদ্দিস আবাবার যুদ্ধে মুসলমানরা বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিল। হারারী মুসলিম স্কোয়াডের দুর্ধর্ষ বীরত্ব যুদ্ধের মানচিত্র বদলে দিয়েছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। ইথিওপিয়ান বাহিনী পরাজিত হল। ইথিওপিয়া চলে গেল ইতালির অধীনে। 


১৯৩৬ সাল থেকে ১৯৪১ পর্যন্ত। স¤্রাটকে আশ্রয় দিল ব্রিটেন। শুরু হল দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ। ১৯৪১ সালে ব্রিটেন পরাজিত করে ইতালিকে। দখল করে নেয় ইথিওপিয়া। 

তারপর আসে আমেরিকা। ব্রিটেনের অধিকার খর্ব করে আমেরিকা এখানে নিজেদের অর্থনৈতিক বলয় তৈরী করে। আমেরিকার সহযোগিতায় ইথিওপিয়ায় গড়ে ওঠে আফ্রিকার সবচেয়ে বড় এয়ারলাইন্স। ইথিওপিয়া থেকে প্রথম বিমান ওড়ে ১৯৪৬ সালে। 

ইথিওপিয়ায় নানা সমস্যা হয়েছে, কিন্তু ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সের উপর এর কোনও প্রভাব পড়েনি। 


.-তারপর কী হল, বিলালের দাদাভাই কোথায় গেলেন?

-দুর্ভাগ্যবশত বিলালের দাদু সে যুদ্ধে ইতালিয়ানদের হাতে বন্দী হল। আরও অনেক সৈন্যকেই বন্দী করা হয়েছিল। খ্রিস্টানদের ছেড়ে দেয়া হল। মুসলিম সৈন্যদের নিয়ে যওয়া হল ইতালিতে। আমেরিকায় দাসপ্রথা নিষিদ্ধ হয়েছিল ১৮৬৫ সালে। আমেরিকার আগে বা পরে ইউরোপের অন্য দেশেও দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু অধীনস্থ দেশের জনগনের প্রতি ইউরোপিয়ানদের প্রভুসুলভ মনোভাব এর একশ বছর পরেও বদলায়নি। খোদ আমেরিকাতেই সত্তর আশির দশকেও কালোদের প্রতি বৈষম্য বিদ্যমান ছিল।

 বিলালের দাদার নাম ছিল আজুবা বকর। রোমে তাকে একটা সেনানিবাসে রাখা হয়েছিল। মানুষটাকে দাসের মতো খাটানো হত। দিনরাত অমানুষিক পরিশ্রম করতে হত। সৈনিকদের হেন কাজ নেই, তাকে করতে হয়নি।

 কিছুদিন এভাবে পশুর খাটুনি খেটে শরীর ভেঙে পড়ল। সেনা কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে হাসপাতালে ভর্তি করাল। সেটা ছিল ভ্যাটিকান পরিচালিত একটি দাতব্য হাসপাতাল। .
ডাক্তার নার্স প্রায় সবাই ভ্যাটিকান চার্চের নিয়োগকৃত। হাসপাতালের ইটটা পর্যন্ত খ্রিস্টধর্ম প্রচারক। এখানে অন্য কোনও রুগি ছিল না। সবই বিভিন্ন দেশ থেকে বন্দী করে আনা কালো মানুষ। 

একটা কথা চালু ছিল, এখানে কেউ একবার ভর্তি হলে, খ্রিস্টান না হলে বের হতে পারে না। আগ্রহে না হলেও ভয়েও অনেকে খ্রিস্টান হয়ে যেত। একটু সুস্থ্য হলে বলা হত, খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলে তোমাকে চার্চের অধীনে কোনও দেশে পাঠিয়ে দেয়া হবে। সুখে শান্তিতে চার্চের সেবা জীবন কাটাতে পারবে। নইলে আবার সেনা ব্যারাকে পাঠানো হবে। কোন দিকে যাবে বলো! এমন প্রস্তাবে, অত্যাচারে জর্জরিত কালো মানুষগুলো ধর্মান্তরিত হওয়াকেই শ্রেয় মনে করত। কিন্তু বিলালের দাদা প্রস্তাবটা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করল। 


.শুরু হল দ্বিতীয়বারের মত দাসের জীবন। অত্যাচার পরিশ্রম আগের তুলনায় আরও বেড়ে গেল। আগে রাতের বেলা বিশ্রামের সুযোগ দেয়া হত। এখন তাও দেয়া হয় না। এটা ছিল পরিকল্পিত! যাতে কেউ দ্বিতীয়বার ব্যারাকে না এসে ভ্যাটিকানের কথা মেনে নেয়। অল্প ক’দিন পরই মানুষটা আবার অসুস্থ হয়ে পড়ল। চার্চ কর্তৃপক্ষ এ-ধরনের ঘটনার সাথে পরিচিত। তারা কৌশলে অগ্রসর হল। বেলালের দাদুর মত যারা পোশ মানতে চাইত না, তাদের জন্য ছিল অন্য ব্যবস্থা। এ-ধরনের লোকদেরকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ভিন্ন ওয়ার্ডে রাখত। বাইরে থাকত কড়া সামরিক পাহারা। কেউ এখান থেকে পালিয়ে যাবে, সে সুযোগ নেই। 


মানুষটাকে এবার বিশেষ নজরদারিতে রাখল। এখানে ডাক্তার নার্স সেবিকা সবাই মেয়ে। ওয়ার্ডে সব সময় কিশোরী ও তরুণী সেবিকারা থাকত। সবাই সুন্দরী। এদেরকে আনা হতো ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। কারো বাবা যুদ্ধে নিহত! কারো বাবা-মা দু’জনেই প্রথম বিশ^যুদ্ধে নিহত! কারো ঘর বাড়ি নেই। কেউ পরিবারের চাপে নান হতে এসেছে। কেউ স্বেচ্ছায় কুমারী মেরীর মতো হতে এসেছে। কেউ কেউ ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের ধাক্কার চাপ সইতে না পেরে জীবন থেকে পালাতে চার্চে এসে আশ্রয় নিয়েছে। কাউকে গোয়েন্দা সংস্থা নিয়োগ করেছে। শুনতে অবিশ্বাস্য ঠেকলেও, সেই মেয়েদের অনেককে বিভিন্ন শহরের খারাপ জায়গা থেকেও সংগ্রহ করে আনা হত। বেওয়ারিশ মেয়েরাই বেশি কাজে আসত। কারণ তাদের কোনও পিছুটান থাকে না।


 মাঝেমধ্যে সমস্যা যে বাঁধত না, তা নয়। অনেক সময় দেখা যেত, মা খারাপ পাড়ায় থাকলেও, মেয়ের প্রতি দাবী ছাড়ত না। আবার কখনো কখনো মা ও বাবা দু’জনেই বিয়ে করতে সম্মত হয়ে যেত! তখন সন্তানকে ফিরিয়ে নিতে আসত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চার্চ রাজি হত না। বাবা-মা জোরাজুরি করলে চার্চ নিজের অপরিমেয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাদেরকে হাঁকিয়ে দিত! অনেক মেয়ে ছিল, তাদেরকে ছেলেধরাদের হাত থেকে কিনে নেয়া হয়েছে। এদেরকে বিশে^র বিভিন্ন স্থান থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হত। একদম ছোটবেলায়। আরও অসংখ্য ধাঁচের মেয়ে থাকতো চার্চে। তাদেরকে সব ধরনের শিক্ষা দিয়ে জ্ঞানে-গুণে নিপুণা করে তোলা হত। তাদের সব দক্ষতা ব্যয় হতো যিশুর কল্যাণে। খ্রিস্টবাদের প্রচারে। বিধর্মীদেরকে খ্রিস্টবাদে দীক্ষিত করার কাজে। 


.

মুসোলিনির মতো ফ্যাসিস্টের শাসনেও ভ্যাটিকানের ধর্মসাম্রাজ্য নির্বিঘ্নে চালিয়ে যেতে কোনও সমস্যা হয়নি। এই মেয়েরা ছিল অত্যন্ত প্রশিক্ষিত। হাসপাতালটা ছিল তাদের স্কুল-কলেজ-ভার্সিটি। চার্চ কর্তৃপক্ষ প্রত্যেকের গতিবিধি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণে রাখত। রুগিদের সাথে কে কেমন আচরণ করছে, কেমন অভিনয় করছে, দূর থেকে লক্ষ্য রাখত। কেউ যদি অভিনয়ের অতিরিক্ত কিছু করার দিকে অগ্রসর হতো, শাস্তিস্বরূপ তাকে কিছুদিন হাসপাতালের ডিউটিতে আসতে দেয়া হত না। রান্নাঘর ও বাথরূপ পরিষ্কারের কাজে লাগানো হতো। প্রচণ্ড রোদে বাগানের আগাছা সাফাইয়ে লাগিয়ে দেয়া হত! বড় যাজকদের গৃহকর্মে লাগিয়ে দেয়া হত। তাদের সব ধরনের সেবায় নিজেকে বিলীন করে দিতে হত। 


.বিলালের দাদা যে ওয়ার্ডের রুগি ছিলেন, সেটা ছিল সর্বোচ্চ গুরুত্বপ্রাপ্ত ‘দাস’দের জন্যে নির্দিষ্ট। ওয়ার্ডের গুরুত্বানুযায়ী ‘মেইড’ নির্ধারন করা হত। গুরুত্বপূর্ণ বা মেধাবী কোনও ‘বন্দী’ হলে, তার জন্যে নিয়োগ করা হত চৌকশ ও অতি সুন্দরীদেরকে। সুন্দরীরা নানা ছলাকলায় ভোলানোর চেষ্টা করত রুগিদেরকে। 

রুগিরাও ব্যাপারটা যে বুঝত না তা নয়। কিন্তু না বোঝার ভান করা ছাড়া ভিন্ন উপায় ছিল না। মুখ বুজে পরিণতির অপেক্ষা করতে হত। দুর্বল শরীরে, অবসন্ন মনে কাঁহাতক এতসব আকর্ষণীয় প্রলোভন এড়ানো যায়? সবার মধ্যে দ্বীনি শিক্ষা অতটা প্রবল ছিল না। বেশির ভাগ বন্দীই ছিল পিছিয়ে পড়া আফ্রিকা থেকে আসা। ইতালির উপনিবেশগুলো থেকে তাদেরকে নানা কৌশলে নিয়ে আসা হয়েছে। বিলালের দাদা আর তার সাথের কিছু মানুষ ছিলেন ব্যতিক্রম। তাদেরকে ষড়যন্ত্র করে বন্দী করে নিয়ে আসা হয়েছে। 


.সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণা একটি মেয়ে, নাম ছিল জুলি। সে বিলালের দাদুর ওয়ার্ডে কাজ করার দায়িত্ব পেয়েছিল। একটা ওয়ার্ডে পালাক্রমের অনেক মেয়েই দায়িত্ব পালন করত। প্রতিবারে দশজন করে। জুলির পালা বেশির ভাগ সময় পড়ত রাতের দ্বিতীয়ার্ধে। সকাল পর্যন্ত জুলিদের দল রুগির দেখভাল করত। 

জুলিরা রাত একটায় কাজ শুরু করত। কাওকে ওষুধ খাওয়ানোর পালা থাকলে খাওয়ানো হত। এরপর রুগিদের সাথে সাথে সেবিকারাও এখানে ওখানে বসে বসে ঢুলত। 

কেউ কেউ অতি উৎসাহী রুগিদের সাথে গল্প জুড়ে দিত। গল্প করতে চাইলে সেবিকারা ভীষণ খুশি হত। কথা বলতে পারলেই তাদের লাভ। যে যত বেশি কথা বলতে পারবে, সে তত নাম্বার পাবে। রুগিকে খ্রিস্টবাদের দাওয়াত দিতে পারবে। 

.জুলি সব সময় বিলালের দাদুর আশেপাশে থাকার চেষ্টা করত। তিনি ছিলেন অন্য সবার চেয়ে আলাদা। তরুণ বয়েসেই তার গাম্ভীর্য আর রাশভারী ধীরস্থির আচরণ অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করত। তিনি মনেপ্রাণে ধার্মিক ছিলেন। ইসলামের জন্যে কিছু করার জন্যে সব সময় মুখিয়ে থাকতেন। ছেলেবেলা থেকেই ধার্মিক পরিবারে বেড়ে উঠেছেন! তাই ইতালিয়ানদের আগ্রাসনের মুখে বসে থাকতে পারেননি। খ্রিস্টান শক্তির বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। 

যদি খ্রিস্টান রাজা হাইলে সেলাসের পক্ষ হয়েই লড়েছিলেন, কিন্তু সে লড়াই ইসলামী হারারকে রক্ষার লড়াইও ছিল। কারণ আদ্দিস আবাবা ইতালির দখলে গেলে, হারারও যাবে। 

এদিকে লক্ষ্য রেখেই হারারের ওলামায়ে কেরাম খ্রিস্টান সম্রাটের পাশে দাঁড়িয়েছিল। আর সম্রাট আশ্বাস দিয়েছিল, তার পক্ষ হয়ে লড়লে, হারার সম্পর্কে তিনি ভেবে দেখবেন। 

এ-অঞ্চলকে বাড়তি কিছু অধিকার দেয়া যায় কি না! 

.জুলিকে ধরে আনা হয়েছিল ফ্রান্সের একটা গ্রাম থেকে। তার বাবা-মা দুজনেই মারা গিয়েছিলেন। তারা থাকতো আলজেরিয়াতে। সেখানকার স্বাধীনতাকামীদের হামলায় দু’জনইে নিহত হয়েছিল। তার বাবা একজন সামরিক অফিসার ছিল। বাবা আর মায়ের মৃত্যুর পর তাকে দেখাশোনা করার মত কোনও নিকটাত্মীয় ছিল না।

 প্যারিসের একটা গীর্জা এ-ধরনের বাচ্চাদের দায়িত্ব নিত। সে গীর্জা থেকেই ভ্যাটিকান তাকে সংগ্রহ করে রোমে নিয়ে আসে। একটু বড় হওয়ার পর জুলি ভ্যাটিকান ছাড়তে চেয়েছিল। কিন্তু জোর করে তাকে আটকে রাখা হতো। সে আলজেরিয়া থাকাকালে ছোটবেলাতেই মুসলমান দেখেছে। আরবী ও কালো মানুষ দেখেছে। তাদের প্রতি এক ধরনের ভাল লাগাও বোধ হয় ছিল। 

অফিসে তাদেরকে প্রতিটি পেশেন্টের জীবনবৃত্তান্ত পড়তে হত। সেখানেই সে বিলালের দাদু সম্পর্কে বিস্তারিত জেনেছে। তারপর কাছে থেকে দেখে তার মুগ্ধতার মাত্রা বেড়েই চলেছিল। 

জুলি ভাবত, একটা মানুষ সারাদিন চুপচাপ থাকে কী করে? তার কথা বলতে ইচ্ছা করে না? আর মানুষটার শেখার ইচ্ছাও প্রশংসনীয়। হাসপাতালে শুয়ে-বসেও বিভিন্ন বই পড়ার চেষ্টা করে। ইতালিয়ান ভাষা শেখার চেষ্টা করে। ইংরেজি আগে থেকেই পারত, এখন আরও ভাল করার জন্যে চেষ্টা করছে! বেশ দ্রুত উন্নতিও করছে। আগে একটা বই পড়তে যা সময় লাগত এখন তা চেয়েও কম লাগছে। .


চার্চের পক্ষ থেকে বাইবেল পড়তে দেয়া হতো। চার্চ আগে থেকে ঠিক করে রাখতো, কাকে কোন ভাষাভাষীদের অঞ্চলে পাঠানো হবে! তাকে সে ভাষার বাইবেল দেয়া হত। দীক্ষা ও শিক্ষা যেন একসাথে হয়ে যায়। বিলালের দাদাকে বাইবেল বুঝিয়ে দেয়ার দায়িত্বও ছিল জুলির উপর। তার ভাষা ছিল ফ্রেন্স। তাকেও ভবিষ্যতে ইংরেজী ও ফ্রেন্স ভাষা মিশ্রিত অঞ্চলে পাঠানো স্থির করে রাখা হয়েছিল। এখন পড়াতে গিয়ে, জুলিরও ইংরেজি ভাষাটা আরও সড়গড় হবে। 

নিজের শিক্ষা ও অন্যকে শেখানো একসাথে চলবে। বিলালের দাদা জুলির কাছে বাইবেল পড়তে অস্বীকার করেছিল। কিন্তু না পড়ে উপায় নেই। পড়তেই হবে। চার্চের কথামত না চললে, সোজা ব্যারাকে পাঠিয়ে দেয়া হবে। অসুস্থ্য হলেও মাফ নেই। তাই বাধ্য হয়েই পড়তে হল। 


.যতই দিন গড়াল, জুলি শিক্ষক থেকে কোন ফাঁকে শিক্ষার্থীতে পরিণত হয়েছিল, সে টেরও পায়নি। খ্রিস্টধর্ম নিয়ে বিলালের দাদারও কম জানাশোনা ছিল না! এই হারার শত বছর ধরে মুসলিম অধ্যুষিত হলেও, আশেপাশের অঞ্চলগুলো খ্রিস্টান অধ্যুষিত ছিল। আফ্রিকার প্রায় সব দেশ ইউরোপিয়ান খ্রিস্টানদের নতুন উপনিবেশ হলেও, সেই প্রাচীন কাল থেকেই ইথিওপিয়াতে খ্রিস্টানদের বসবাস! এ-কারণেই বোধ হয়, ইউরোপিয়ানরা এদিকে খুব একটা লোভাতুর দৃষ্টি দেয়নি। -তাহলে দাদু, ইতালি কেন দৃষ্টি দিয়েছিল?


-ইতালির মুসোলিনি ছিল স্বৈরাচার! সে ইউরোপের অন্য দেশের মতো আফ্রিকায় নিজের একটা শক্ত অবস্থান তৈরী করতে চাচ্ছিল! কিন্তু সে বেশিদিন সুবিধা করতে পারেনি। কারণ তাকে লিবিয়াতে মুজাহিদ বাহিনী ঠেকাতে প্রায় সর্বশক্তি ব্যয় করতে হচ্ছিল! আর এখানকার খ্রিস্টান রাজাও মুসলিমদের প্রতি খড়গহস্ত ছিল।

 তুমি কিছু মনে করো না, খ্রিস্টান রাজাদের বদনামি তোমার কাছে খারাপ লাগতে পারে! 

-না না দাদু! ইতিহাস তিক্ত হলেও মেনে নেয়াই যুক্তিযুক্ত! -সম্রাট হাইলে সেলাস হারারের মুসলমানদেরকে অত্যন্ত চাপের মধ্যে রেখেছিল। তোমাকে আগামীকাল নিয়ে যাবো, দেখবে এখানকার বড় মসজিদটিকে খ্রিস্টানরা কিভাবে গীর্জায় রূপান্তরিত করেছে।-সত্যিই?

 -হু, কাল নিজের চোখেই দেখতে পাবে! অথচ মসজিদটা ছিল অনেক পুরনো! এসো, মুল ঘটনায় ফিরে যাই। 

চার্চের পক্ষ থেকে জুলি ও বেলালের দাদুকে পাঠানো হলো কানাডায়। আমি যে স্কুলে পড়তাম সেখানে। 

রেসিডেন্সিয়াল স্কুলগুলোর পক্ষ থেকে ভ্যটিকানে শিক্ষক-শিক্ষিকা চাওয়া হত! এমনকি গীর্জার ফুট-ফরমাশ খাটার জন্যে কাজের লোকও চাওয়া হতো! স্কুলের চাওয়ার প্রেক্ষিতেই জুলিকে শিক্ষিকা হিশেবে পাঠানো হল। সাথে কাজের লোক হিশেবে বেলালের দাদাভাইকে। 

- দাদাভাই ভ্যাটিকানের সব চাওয়া ও দাবী মেনে নিয়েছিলেন? 


-বাহ্যিকভাবে মেনে নিয়েছিলেন। না মেনে উপায় ছিল না। তাকে বলা হয়েছিল, বাড়ি ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। গেলেই সম্রাটকে বলে আবার ধরে আনা হবে। পাশাপাশি বাবা-মা আত্মীয় স্বজন সবাইকে মেরে ফেলা হবে। এমন হুমকি পেলে কেইবা ফিরে যেতে চায়। তিনি অগত্যা ঠিক করেছিলেন, অন্য কোথাও পালিয়ে যাবেন। চার্চ কর্তৃপক্ষ এটাও টের পেয়ে গিয়েছিল। তারা আগাম জানিয়ে রেখেছিল, যেখানে পাঠানো হচ্ছে সেখান থেকে পালালেও একই পরিণতি বরণ করতে হবে! -ইথিওপিয়ার সম্রাট ভ্যাটিকানের কথা মানবেন কেন? 


-সব শেয়ালের এক রা! তলে তলে সবাই এক। আর সম্রাট হাইলে সেলাস নিজেকে সরাসরি নবী সুলাইমান আ.-এর বংশধর মনে করে। তার সাথে খ্রিস্টান ও ইহুদিদের অনেক গোপন সংগঠনের যোগাযোগ আছে! তাকে ঘিরে একটা ধর্মমতই দাঁড়িয়ে গেছে। রাস্তাফারি। ওই যে একজন গায়ক ছিল না, নো ওমেন নো ক্রাই (নারী তুমি কেঁদো না), কী নাম যেন, বাড়ি কারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের জ্যামাইকাতে। -বব মার্লে!-ওমা, তুমি চেন তাকে?-কেন চিনবা না। ভাল করে চিনি। তিনি আমাদের কানাডাতে কনসার্ট করেছেন ১৯৭৯ সালে। আমাদের ক্লাসে একটা মেয়ে পড়ে। ডোনা। সে ববের অন্ধভক্ত। ডোনার বাড়ি ভ্যাঙ্কুবারে। তাদের শহরেও একটা কনসার্ট হয়েছিল। সেই আমাদেরকে ববের কথা বলে। কালো মানুষদের ন্যায্য অধিকারের কথা, রেড ইন্ডিয়ানদের প্রতি বৈষম্যের কথা তার মুখেই শুনেছি। নিপীড়িত মানুষের প্রতি বব মার্লের সংগ্রামকে সে রীতিমতো পূজা করত। বব মার্লের মতো ডোনাও চুলকে জটাদার করে রাখতো। সে আমাদেরকে তার ধর্মমতের দাওয়াত দিত। রাস্তাফারা ধর্ম। 
-ঠিক বলেছ। সম্রাট হাইলে সেলাসি হল সে ধর্মের প্রধান পুরোহিত। ঈশ্বরের পুত্র। কালো মাসীহ। ব্ল্যাক যিশু। রাস্তাফারা ধর্ম খ্রিস্টধর্মেরই নতুন আরেক রূপ। বব মার্লের মাধ্যমে এই ধর্মমত বিশ্বব্যাপী প্রচার পায়। জ্যামাইকা ছিল রাস্তাফারা ধর্মের কেন্দ্রভূমি। আর ইথিওপিয়া তাদের কাছে প্রমিজ ল্যান্ড। ধর্মভূমি। সম্রাট নিজের ভক্তদের দেখা দেয়ার জন্যে তৎকালীন ব্রিটিশশাসিত জ্যামাইকা সফরেও গিয়েছিলেন। 
-আচ্ছা, তারপর কী হল?-জুলি রোমে থাকতেই বিলালের দাদুর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছিল। সে ছোটবেলায় আলজেরিয়া থাকাকালে আরবী শিখেছিল। তাদের বাসায় এক মুসলিম দম্পতি থাকত। কাজের লোক হিশেবে। সে দম্পতিই তাকে লালন পালন করেছিল। জুলির মা ছিল অত্যন্ত রোগা! এজন্য তার বাবা দিনে মুসলিম স্বাধীনতাকামীদের হত্যা করত, রাত মদ আর পরনারী নিয়ে আকণ্ঠ নিমজ্জিত থাকত। এদিকে জুলি বেচারা একা একা! তখন মুসলিম সেই দম্পতি তার দিকে স্নেহের হাত বাড়িয়ে দিল। অবশ্য তাদের প্রধন দায়িত্বই ছিল জুলির দেখাশোনা করা। সেই মুসলিম মহিলা তাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। 
মায়ের অসুস্থতার সুযোগে তাকে আরবী শিখিয়েছে। আদব-লেহাজ শিখিয়েছে। আরও বহুকিছু। জুলি চার্চের কাছে আবেদন করেছিল, তাকে যেন আলজেরিয়াতে পাঠানো হয়। সেখানে চার্চের কাজ এখনো জোরাল না হওয়াতে পাঠানো গেল না। জুলি মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল, জীবনে একবার হলেও তার পালক মায়ের সাথে দেখা করবে। পারলে তাকে কাছে এনে রাখবে। তার সুযোগ সুবিধা দেখবে। তাকে না পেলে তার ছেলেসন্তানকে। বেলালের দাদাভাইকেও বলে রেখেছিল, সে যদি কোনও কারণে যেতে না পারে, তার বদলে বিলালের দাদাভাই যেন পালক মাকে খুঁজে বের করে। কানাডায় বিলালের দাদাভাইয়ের কাজ ছিল চার্চ ও স্কুলের যাবতীয় ব্যবস্থাপনা তদারক করা। চার্চের প্রার্থনা সভা প্রস্তুত রাখা। স্কুলের ছেলেমেয়েদের উপর গোপন নজর রাখা। তাদের আচার-আচরণের প্রতি লক্ষ্য রাখা। কাজটা পছন্দ না হলেও করতে হত। এখানে আসার পর বাড়তি সুবিধা এটুকু হয়েছে, আগের মত বন্দী হয়ে নির্দিষ্ট একটা চৌহদ্দীর ঘেরাটোপে অন্তরীন হয়ে থাকতে হয় না। চার্চের কাজ করলেও নিজের একান্ত কিছু সময় থাকে। গোপনে কিছু করতে চাইলে সুযোগ আছে। .


কানাডা আসার পর, জুলির সাথে দেখা-সাক্ষাত কমে গেছে। শুধু রোববারে চার্চে দেখা করা সম্ভব হয়। তাও একটুখানি সময়ের জন্যে। বাকি দিনগুলো দু’জন বিচ্ছিন্ন। অল্প যেটুকু সময় পাওয়া যায়, সেটাওবা কম কি! জুলি বারবার বলছে, দু’জন মিলে কোথাও পালাতে! সেটা সম্ভব নয়। পালালেই হারারের মানুষগুলোকে কষ্ট দেয়া হবে। এখানেই থাকতে হবে। কোথাও যেতে হলে এখানকার অনুমোদন ক্রমেই যেতে হবে। এক রোববারে বেলালের দাদাভাইয়ের কাছে জুলি বলল:-------


-আমাকে একজন ফাদার খুব বেশি উত্যক্ত করছে! তিনি স্কুলে অংক পড়ান! তার অনেক দাপট। আমাকেও তার সহকারী হিশেবে নিয়োগ দিয়েছেন। তিনি রেড ইন্ডিয়ান মেয়েদের উপর অসমিচীন আচরণ করেন। আমি এর প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম। তিনি রেগেমেগে আমার উপরই চড়াও হতে উদ্যত হয়েছেন। তার সাথে আরও সহযোগী আছে। তারাও ফাদারকে পাপকার্যে সহযোগিতা করে! -তুমি সাহস হারিও না জুলি! আমি দেখি কী করা যায়! এখানে আসার পর থেকেই অনেক কিছু চোখে পড়ছে! এর তুলনায় ভ্যাটিকানকে নিষ্পাপ বলা যায়! এভাবে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের উপর নির্যাতন করা যায়? কোনও মানুষ করতে পারে? এরা নাকি ফাদার! এরা নাকি নান! 
-দাদু তুমি তখন ও স্কুলে পড়তে না?


-জি¦ পড়তাম! -বিলালের দাদার সাথে কিভাবে পরিচয়? -রোববারে চার্চে পুরো স্কুলের ছাত্র-শিক্ষক সবাই প্রার্থনা সভায় উপস্থিত হত। আমিও সে রোববারে হাজির হয়েছিলাম। ফাদার মূল প্রার্থনা শুরু করার পর আমার একটু বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন দেখা দিল। আমি সন্তর্পণে বের হলাম। তাড়াহুড়ার কারণে ভুলে আরেক দরজায় দিয়ে ঢুকে পড়লাম! অবাক হয়ে দেখি সিস্টার জুলিকে কী যেন লিখে লিখে শেখাচ্ছেন মি. জ্যাকব! -মি. জ্যাকবই বুঝি বিলাল ভাইয়ার দাদাভাই?-জি¦। আমাকে দেখেই মি জ্যাকব ধড়মড় করে কাগজটা লুকিয়ে ফেললেন! সিস্টার দৌড়ে এসে আমাকে টেনে ভেতরে নিয়ে গেলেন। আমার দু’হাত চেপে ধরে ভীত স্বরে বললেন,-তুমি এখানে যা দেখলে, তা কারো কাছে বলো না! তোমার কাছে মিনতি করছি! 


.সিস্টার জুলিকে এমনিতেই আগে থেকে ভালবাসতাম। পুরো রেসিতে একমাত্র তিনিই আমাদের প্রতি সদয় নরম আচরণ করতেন। অন্য সবার মতো জুলুম করতেন না। কথায় কথায় পিটুনি লাগাতেন না। খুবই মমতা দিয়ে অংক শেখাতেন। সেদিনের ঘটনার পর থেকে তার প্রতি কৌতূহল আরো বেড়ে গিয়েছিল। তিনিও আমার প্রতি বাড়তি মনোযোগ দিতেন। আড়ালে-আবডালে ডেকে কথা বলতেন। তার ফরমাশ খাটানোর ছলে তার কক্ষে ডেকে নিতেন। দরজা বন্ধ করে গল্প করতেন। কিন্তু আমি শত চেষ্টা করেও তারা সেদিন কী পড়ছিলেন, তা বের করতে পারিনি। অনেক পরে বিলালের দাদা ভাইয়ের কাছে জেনেছিলাম! -কী করছিলেন?


-সূরা ফাতিহা পড়ছিলেন। বিলালের দাদু নিজের হাতে লিখে মিস জুলিকে শেখাচ্ছিলেন। তাদেরকে দেখলে পাক্কা খ্রিস্টান ছাড়া আর কিছু মনে হত না! তাদের বিয়ের কথা জানতে পেরেছিলাম আরও বহু পরে। এখানে চলে আসার পর। আমি তখনো ইসলাম কী, মুসলমান কী কুরআন কী, কিছুই জানতাম না। আমরা জানতাম যিশুর কথা। বাইবেলের কথা। খ্রিস্টবাদের কথা। মেরির কথা। বিশে^ আর কোনও ধর্মের অস্তিত্ব আছে, সেটা প্রথম জেনেছি মিস জুলির কাছে।

 মি. জ্যাকবকে আমরা বোকাসোকা একজন কালো মানুষ বলে ধারনা করতাম। থাকতেনও অমন করে। পরে বুঝেছিলাম, সেটা ছিল তার অভিনয়। ভেতরে ভেতরে তিনি আমাদের অনেক সহযোগিতা করতেন। সেটা আমরা কিছুতেই টের পেতাম না। তার দায়িত্ব ছিল আমাদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরি করা। তিনি আমাদেরকে মার খাওয়ানোর হাজারো সুযোগ পেয়েও কর্তৃপক্ষের কাছে কোনও অভিযোগ দায়ের করতেন না। আমরা আস্তে আস্তে তার মমতাপূর্ণ হৃদয়ের সন্ধান পেয়েছিলাম। কিন্তু বাইরে বাইরে তিনি আমাদের প্রতি অত্যন্ত কঠিন আচরণ করতেন। 


.সিস্টার জুলির সাথে আমার সম্পর্ক এমন হল, প্রতিদিনই তার সাথে কোনও কোনও ছুতায় গল্প করতে যেতাম। বিকেলে আমরা বাগানে পানি দেই। মিস জুলি সাথে থাকেন। একদিন আমাদের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও তার দেখা নেই। তারপর দিনও দেখা নেই। আমরা ভেবেছি তিনি অসুস্থ। তার ঘরে গেলাম। তালা ঝুলছে। টনক নড়ল। কী ব্যাপার? কোথায় যেতে পারেন? কোথাও গেলে আগে থেকে একটু আভাস তো দিবেন। 

আমি তখন রেসির শেষ ক্লাসে পড়ি। আগামী বছর বের হয়ে যাবো। মুক্ত পৃথিবীতে। অন্যদের তুলনায় আমাদের কিছু চলাফেরার স্বাধীনতা ছিল। আমি এক ফাঁকে মি. জ্যকবের কাছে গেলাম। তিনি আমার কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লেন। তিনিও জানেন না। সেই গত রোববারে চার্চের সময় দেখা হয়েছিল। 

এরপর আর দেখা বা কথা কোনওটাই হয়নি। তিনি ব্যকুল হয়ে পড়লেন। কিন্তু কারো কাছে সেটা প্রকাশও করতে পারছিলেন না। একদিন দু’দিন করে সপ্তাহ কেটে গেল। মিস জুলির দেখা নেই। কর্তৃপক্ষেরও এ-ব্যাপারে কোনও হেলদোল দেখা গেল না। পরে চাপা ফিসফাস থেকে জেনেছিলাম, আমাদের অংকের টিচার ফাদারই মিস জুলির সাথে দুর্ব্যবহার করে তাকে গুম করে ফেলেছিলেন। এমন গুমের ঘটনা একটা দু’টো নয়। রেড হাজারো ইন্ডিয়ান ছাত্র-ছাত্রীকে নির্যাতন করে গুম করে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু তাই বলে ভ্যাটিকান থেকে পাঠানো শিক্ষিকাকেও? আমরা আর কোও খবর জানতে পারিনি। স্কুল থেকে বের হওয়ার পরও আমি চেষ্টা করেছিলাম। কোও সূত্র বের করতে পারিনি। তবে ঘটনাটার কথা উর্ধতন মহল বিলক্ষণ জানতেন। পরে তার প্রমাণ পেয়েছি। 


.এ ঘটনার পর মি. জ্যাকব ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আমি ও কয়েকজন ছেলেমেয়ে গোপনে তার সেবা করতাম। তখন আমি তাকে আরও ভাল করে চিনতে পারি। তার সুন্দর মনের পরিচয় পাই। আমি একদম বাচ্চাকাল থেকেই রেসিতে বন্দী। বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে কোনও খবর জানতাম না। চার্চের বর্বর ফাদার ও পশুহৃদয় শিক্ষকদের দেখে দেখে মনে হয়েছিল, সব পুরুষই বুঝি এমন? শুধু পুরুষই কেন, সব শাদা নারীও বুঝি এমন হিংস্র আর জানোয়ার স্বভাবের হয়ে থাকে? 

মি. জ্যাকবকে দেখে ভুল ভাঙল। তখন আমি সদ্য কৈশোর পার হয়ে এসেছি। মনে অনেক রঙিন কল্পনা। একজন ব্যতিক্রমী পুরুষ দেখে মনের অবস্থা অন্যরকম হয়ে গেল। হোক না কালো! হোক না মানুষটা আমার চেয়ে বয়েসে অনেক বড়। 
.আমার স্কুলের পাঠ চুকল। স্কুল কর্তৃপক্ষ বলল চার্চের সেবায় আত্মনিয়োগ করতে। আমি রাজি হলাম না। পরে মনে হল, এখান থেকে বেরিয়ে গেলে মি. জ্যাকবকে হারাতে হবে। আবার থাকলেও বদচরিত্র ফাদারদের হাতে সবকিছু হারানোর ভয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একবছর থাকার শর্তে রাজি হলাম। দেখতে দেখতে বছরটা কেটে গেল। মি. জ্যাকবকে সব সময় কাছে পেয়েছি। তার সহযোগিতা পেয়েছি তাই সময়টা কাটাতে কষ্ট অনুভব হয়নি। মিস জুলি গুম হওয়ার পর, চার্চের সেবিকাদের সাথে দুর্ব্যবহারের মাত্রা কমে এসেছিল। ভ্যাটিকান থেকে নাকি প্রতিনিধি পাঠানো হয়েছিল। মিস জুলির অন্তর্ধানরহস্য উদঘাটন করতে। তাদেরকে কী বুঝ দেয়া হয়েছিল জানিনি, তবে রেসি কর্তৃপক্ষ সতর্ক হয়ে গিয়েছিল। ভালোয় ভালোয় সময়টুকু কেটে গেল। .


মুক্ত দুনিয়াতে বের হয়ে এলাম। মি. জ্যাকব অনেক সাহায্য করলেন। তিনি স্কুলের কাজে প্রায়ই শহরে যেতেন। তার সাথে অনেক কালো মানুষের পরিচয় ও সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তাদের সূত্রে আমার থাকা ও খাওয়ার বন্দোবস্ত হলো। পড়াশোনার ব্যবস্থা হল। নির্যাতিত রেড ইন্ডিয়ানদের বিভিন্ন সংগঠনের সাথেও যোগাযোগ গড়ে উঠল। আমরা বাইরে বেরিয়ে আসলেও, কেন্দ্রীয় চার্চের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতে হত। অনেকটা আদালতে হাজিরা দেয়ার মত। চার্চের পক্ষ থেকে আমার কাছে জানতে চাওয়া হল, আমি আফ্রিকার গরীব কোনও দেশে সেবার জন্যে যেতে আগ্রহী কি না! মি. জ্যাকবের সাথে পরামর্শ করলাম। তিনি সম্মতি দিলেন। তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম.


-আফ্রিকার কোন দেশে কাজ করতে পারি?
-তোমাকে বেছে নেয়ার এখতিয়ার দিয়েছে?
-পরিষ্কার করে কিছু না বললেও, মনে হয় বেছে নেয়ার সুযোগ দেয়া হবে।
-আমার মনে হয়, মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতেই তোমাদেরকে পাঠানো হবে। কোনওভাবে চেষ্টা করে দেখবে, গন্তব্যের তালিকাতে ইথিওপিয়ার হারার অঞ্চল আছে কি না। যতদূর জানি থাকার কথা। কারন সেখানে বড়সড় একটা চার্চ খোলা হয়েছে। একটা মসজিদকে জোর করে গীর্জায় রূপান্তরিত করা হয়েছে। গীর্জার পক্ষ থেকে একটা স্কুলও খোলা হয়েছে। 
-তোমাকে বেছে নেয়ার এখতিয়ার দিয়েছে?-পরিষ্কার করে কিছু না বললেও, মনে হয় বেছে নেয়ার সুযোগ দেয়া হবে। -আমার মনে হয়, মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতেই তোমাদেরকে পাঠানো হবে। কোনওভাবে চেষ্টা করে দেখবে, গন্তব্যের তালিকাতে ইথিওপিয়ার হারার অঞ্চল আছে কি না। যতদূর জানি থাকার কথা। কারন সেখানে বড়সড় একটা চার্চ খোলা হয়েছে। একটা মসজিদকে জোর করে গীর্জায় রূপান্তরিত করা হয়েছে। গীর্জার পক্ষ থেকে একটা স্কুলও খোলা হয়েছে। 


.আমার আবেদন মঞ্জুর করা হল। আমি পরিচিত এক প্রভাবশালী নানের মাধ্যমে আবেদন করলাম, আমার ওখানে কাজ করার সুবিধার্থে একজন লোকাল গার্জেন প্রয়োজন।-তুমি ওখানে গিয়ে কাজ শুরু করলে, এমনি এমনি অনেক গার্জেন তৈরী হয়ে যাবে। -একজন লোককে সাথে নিতে পারলে, চার্চ ও স্কুলের অনেক কাজ হবে। তিনি যিশুর একনিষ্ঠ অনুসারী। তাকে পেলে কাজ অনেক দূর এগিয়ে যাবে। তিনি ওখানকর প্রভাবশালী পরিবারের ছেলে। তিনি যিশুর অনুসারী হয়েছেন দেখলে, মানুষ দলে দলে তার অনুসরণ করবে! 


.কাজটা সহজ ছিল না। কিন্তু আমি নাছোড়বান্দী হয়ে লেগে থাকলাম। অনেক চিন্তা-ভাবনার পর চার্চ রাজি হল। স্কুল কর্তৃপক্ষ প্রথমে কিছুতেই মি. জ্যকবকে ছাড়তে রাজি হয়নি। ব্যাপারটা ভ্যাটিকান পর্যন্ত গড়িয়েছে। কিন্তু ভ্যাটিকান তখন অন্য কিছু নিয়ে ব্যস্ত ছিল বিধায় এদিকে মনোযোগ দিতে পারেনি। এদিকে মি. জ্যাকবও কর্তৃপক্ষকে হুমকি দিয়ে বলেছেন, তাকে সুন্দরভাবে ছাড়পত্র না দিলে, ব্যাপারটা কোর্ট পর্যন্ত গড়াবে! ব্যস অমনি কাজ হয়ে গেল। আমরা চলে এলাম হারার। মি. জ্যকব অল্প বয়েসী কেউ হলে, মানুষ অন্যরকম কিছু সন্দেহ করতে পারত! তিনি কালো তার উপর তিনি আমার বাবার বয়েসী। হিশেব করলে দেখা যাবে, আমার বাবার চেয়েও বড়। তাই তাকে সাথে নিয়ে আসার আবেদনে লোকজনের মনে ভিন্ন কিছু জাগল না। 


.বিলালের দাদার বাবা-মা কেউই বেঁচে ছিলেন না। বাবা শহীদ হয়েছিলেন ইতালিয়ানদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে। মা মারা গিয়েছেন স্বামী-পুত্রের শোকে ধুঁকতে ধুঁকতে। তিলে তিলে। তবে জমিজমা সব ঠিকঠাক ছিল। এখানকার মানুষ বেশ সৎ আর ধার্মিক। শত বছর ধরে তাদের মধ্যে নিষ্ঠার সাথে ধর্ম পালনের ব্যাপারটা চলে আসছে। আমি হারার আসার পর ইসলাম নিয়ে একমনে পড়াশোনা শুরু করলাম। চার্চে থাকাকালে আমি ধার্মিক খ্রিস্টান হয়ে থাকতাম। বাইরে বের হয়ে এলে স্বাধীনভাবে চলাফেরার সুযোগ ছিল। এখানে একটা লাইব্রেরী ছিল। আফ্রিকার এতটা ভেতরে এমন লাইব্রেরির প্রচলন অবিশ্বাস্য। অত্যন্ত সমৃদ্ধ এক লাইব্রেরি। সেখানে নিয়মিত পড়াশোনা করতে যেতাম। লাইব্রেরির পরিচালকও ছিলেন একজন পণ্ডিত ব্যক্তি। তার সাথে কথা বলে, ইসলাম, আফ্রিকা, উপনিবেশ, শাদাদের নিপীড়ন সম্পর্কে অনেক অজানা ইতিহাস জানতে পেরেছি। 


.শুরু হল স্কুলের কাজ। আগে থেকেই কার্যক্রম চালু ছিল। আমরা এসে নতুন করে ঢেলে সাজালাম। এখানে আগে নারীশিক্ষার ব্যাপক প্রচলন ছিল। হারার আসার আগে আমাকে ইসলামের ইতিহাস, ইসলামের মৌলিক শিক্ষাগুলো সম্পর্কে ভাল করে ধারনা দেয়া হয়েছিল চার্চের পক্ষ থেকে। সুযোগটাকে কাজে লাগিয়েছিলাম। কাজের সুবিধা হবে, এই ছুতা দিয়ে চার্চের কাছে আরবী শেখার বায়না ধরেছিলাম। তারা রাজি হয়ে ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। কারণ, হারারের মানুষের মধ্যে আরবী জানা লোককে শ্রদ্ধা করার মানসিকতা ছিল। .
গরীব দেশগুলোতে আমরা সাধারণত দেখি, পুরুষরা শিক্ষাদীক্ষায় নারীদের তুলনায় এগিয়ে থাকে। হারার ছিল তার সম্পূণ উল্টো। এখানে পুরুষদের তুলনায় নারীরা বেশি এগিয়ে ছিল। বড় বড় মহিলা মাদরাসা ছিল। সেই শত শত বছর আগে থেকে ঘরোয়াভাবে এই মাদরাসাগুলোর কার্যক্রম চলে আসছে। সম্রাট হাইলে সেলাস ক্ষমতায় বসেই মাদরাসাগুলো বন্ধ করতে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছিল। কয়েক দশক ধরে মহিলা মাদরাসাগুলো বন্ধ হয়ে ছিল। তা সত্ত্বেও ঘরোয়াভাবে শিক্ষার ধারা অবিরত বহমান ছিল। কিন্তু নিয়মতান্ত্রিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে না হলে, কাজের গতি কমে একসময় যতি পড়ে যায়। এখানেও তাই হয়েছিল। চার্চ কর্তৃপক্ষ বুদ্ধি করে মেয়েদের জন্যে আবাসিক স্কুল খুলেছিল। কিন্তু খ্রিস্টবাদ শিক্ষা দেয়ার অপবাদে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদেরকে এখান থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল। এখন নতুন করে শুরু করতে সমস্যা হচ্ছিল। তবুও দু’জনের অক্লান্ত পরিশ্রমে কাজ শুরু হল। আমরা বুদ্ধি করে স্কুলটা শুরু করলাম আগের স্কুলভবনকে বাদ দিয়ে নতুন আরেক স্থানে। 


.আমি বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্রী সংগ্রহ করতে শুরু করলাম। বিলালের দাদাভাই তখনো নিজেকে সবার কাছে খ্রিস্টান হিশেবেই দেখাচ্ছিল। নইলে সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। মানুষ আমাদের প্রচারণায় কিছুটা আস্থার পরিচয় দিল। একজন দু’জন করে ছাত্রী দিতে শুরু করল। না দিয়ে আসলে উপায় ছিল না। মেয়েদের পড়াশোনার ভাল কোনও ব্যবস্থা ছিল না। সরকারের কঠিন নজরদারির চাপে, মেয়েদের মাদরাসাগুলো বন্ধ থাকার কারণে, কিছু পরিবারে মেয়েদের লেখাপড়া ভাল করে হলেও বেশির ভাগ পরিবারের অবস্থা ছিল শোচনীয়। মেয়েদের মাদরাসা নিষিদ্ধ করার মাত্র বিশ বছরের মধ্যেই অবস্থা সম্পূর্ণ বদলে গেল। মেয়েদের ধর্মীয় চেতনা কমে গেল। পরিবারগুলোতে ধর্মীয় মূল্যবোধে ধ্বস নামল। আমি দেখেছি, মুসলিম সভ্যতার স্বর্ণযুগে মেয়েদের শিক্ষাব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত মযবুত। এজন্য পুরুষরাও যোগ্য হয়ে বেড়ে উঠতে পেরেছিল। চারপাশে খ্রিস্টানদের এত শক্তিমত্তা সত্বেও হারারেতে শত বছর ধরে ইসলাম এত গভীর প্রভাব নিয়ে বিদ্যমান থাকার প্রধান কারণও ছিল এখানকার অনন্য সাধারণ মহিলা মাদরাসাগুলো। 


.আমি অভিজ্ঞ ও বয়স্কদের সাথে কথা বলে, আগের শিক্ষাব্যবস্থাটা ভাল করে জেনে নিয়েছিলাম। সত্যিই অবাক করার মতো ঈর্ষণীয় একটা ব্যবস্থা ছিল। হারারে ইসলাম টিকে থাকার প্রধান ভূমিকা মহিলাদেরই ছিল। -কিভাবে? আমি তো শুনেছি, মুসলিম সমাজে মেয়েরা খুব পিছিয়ে থাকে! 


-নাহ, এটা সর্বৈব সত্য নয়। তবে এটা সত্য, ধর্মীয় পরিবারগুলোতে মেয়েরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদীক্ষায় ছেলেদের চেয়ে পিছিয়ে থাকে! তার মানে এই নয়, মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে কম শিক্ষিত বা কম যোগ্য! ধর্মীয় পরিম-লে মনে করা হয়, মেয়েদের দায়িত্ব হল ঘর সামলানো! ভাল মা হওয়া! ভাল স্ত্রী হওয়া। এসব হতে গেলে একজন মেয়েকে অনেক বেশি যোগ্য হতে হয়। এই যোগ্যতা স্কুল-কলেজ-মাদরাসার চার দেয়ালের মধ্যে পাওয়া যায় না। এটা অর্জন করতে হয় ঘরোয়া আবহে। তুমি যদি কাগজের সার্টিফিকেট দিয়ে ধর্মীয় ঘরানার নারীদের যোগ্যতা বিবেচনা করো, তাহলে এক কথায় তাদেরকে পুরুষের তুলনায় পিছিয়ে আছে বলে ঘোষণা দিয়ে বসবে। কিন্তু একটা সুন্দর পরিবার গড়ে তোলা, সন্তান লালন-পালন করা, একজন ভাল আদর্শ স্ত্রী হওয়ার দিকটা বিবেচনা করলে, পুরুষকে নারীর তুলনায় রীতিমতো মূর্খই মনে হবে। কারণ একজন আদর্শ মুসলিম স্ত্রী একসাথে এতগুলো দিক সামাল দেয়, একজন মুসলিম পুরুষ কল্পনাও করতে পারবে না! 
একজন আদর্শ মুসলিম নারী ও মুসলিম পুরুষের যোগ্যতাকে হিমশৈলের সাথে তুলনা করা যায়! একটা হিমশৈলের বেশির ভাগই পানির তলে ডুবে তাকে। সামান্য একটু অংশ পানির উপরে ভেসে থাকে। তোমার বোঝার জন্যে বলছি, একটি মুসলিম পরিবারে একজন নারীর পরিশ্রম ও ভূমিকা পানির নিচে ডুবে থাকা হিমশৈলের মতো। 

-আর পুরুষের ভূমিকা ভেসে থাকা অংশের মতো?-ঠিক তাই। তার মানে এই নয়, মুসলিম পরিবারে পুরুষের ভূমিকা একেবারেই গৌণ! -হিমশৈলের তুলনা কি তাহলে ভুল?-নাহ, ভুল নয়। একটু ভেবে দেখ, একটা সন্তানকে গর্ভে ধারন থেকে শুরু করে প্রায় তিন কি চার বছর পর্যন্ত শিশুকে বড় করে তোলার ক্ষেত্রে বাবার ভূমিকা কেমন? একদম হিমশৈলের মতোই নয় কি?-জি¦ দাদু! এবার ঠিক বুঝেছি! হারারের মুসলিম নারীদের শিক্ষাব্যবস্থাটা কেমন ছিল?



-সে এক অনন্য শিক্ষাব্যবস্থা। মোটা দাগে কয়েকটা দিক তুলে ধরলে বুঝতে পারবে!

☛ ১: আমি হারারে এসে প্রথমে যে লাইব্রেরিতে পড়তে যেতাম, সেটা ছিল ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা। তোমাকে আগামীকাল নিয়ে যাব ওখানে। ওই লাইব্রেরিতে বেশির ভাগ পুঁথি-পুস্তক, কেতাবপত্রই মেয়েদের হাতে লেখা। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হল, হাতে লেখা হলেও, ছাপার অক্ষরের মতো গোট গোট আর পরিচ্ছন্ন! প্রতিটি পা-লিপিই পরিকল্পিত আর গোছালো। পাঠকের পড়তে কোনও সমস্যাই হয় না। আরও অবাক করা বিষয় হয়, লিপিকর মেয়েটি আ-ারলাইনে কঠিন স্থানগুলো সম্পর্কে নিজের বক্তব্যও যোগ করে দিয়েছে। ☛ ২: হারারের প্রতিটি মুসলিম মেয়ে জন্মের পর থেকেই বিশেষ তত্তাবধানে বেড়ে উঠতো। সন্তানসম্ভবা মাকে সব সময় বিভিন্ন আমল, কুরআন তিলাওয়াত, দ্বীনি আলোচনার মধ্যে রাখা হতো। তার ঘরের কাজ কমিয়ে দেয়া হতো। আশেপাশের প্রতিবেশিনীরা এসে তাকে সাহায্য করতো। 


☛ ৩: নবজাতক দেখাশোনার জন্যে প্রতিটি মহল্লায় দু’টি সম্মিলিত ঘর থাকতো। একটা ছেলে সন্তানের জন্যে আরেকটা মেয়ে সন্তানের জন্যে। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর প্রথম কয়েকদিন সেই সূতিকাগার নবজাতকের যাবতীয় দায়িত্ব বহন করত। মা প্রসবজনিত ধকল কাটিয়ে ওঠা পর্যন্ত শিশুকে সূতিকাগারই দেখাশোনা করত। 


☛ ৪: পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় কিছু ঘর নির্দিষ্ট করা ছিল। কোনও বাড়ি ছিল এক নাম্বার বাড়ি, কোনওটা দুই নাম্বার বাড়ি! এভাবে দশ পর্যন্ত থাকত। এক নাম্বার বাড়ি মানে, ও বাড়িতে একজন বা একাধিক অভিজ্ঞ মহিলা আছেন, তারা একবছর বয়েসী শিশুদের বিষয়ে যাবতীয় পরামর্শ দেবেন। পাড়ার সমস্ত এক বছর বয়েসী শিশুদের খোঁজখবর রাখবেন। বিশেষ করে মেয়েদের। দুই নাম্বার বাড়ি মানে দুই বছর বয়েসী শিশুদের দায়িত্বপ্রাপ্তা। 


☛ ৫: এই বাড়িগুলোর অভিজ্ঞ মহিলারা শুধু খোঁজ-খবরই রাখতেন না। শিশুদের লেখাপড়া-শিক্ষাদীক্ষার দিকটাও দেখতেন। একটু বুঝ হওয়ার পর থেকেই শিশুদেরকে তাদের কাছে দিনের কিছু সময়ের জন্যে রেখে আসা হত। শিশুরা সমবয়েসীদের সাথে খেলাধূলা করত। পাশাপাশি টুকটাক মৌখিক শিক্ষাও চলত। শিক্ষাটা কিছুতেই গৎবাঁধা পদ্ধতিতে হত না। খেলাধূলা আর হৈ-হুল্লোড়ের মধ্য দিয়ে হত। 


☛ ৬: একটা অদ্ভুত কাজও করা হতো, মাঝেমধ্যে দিনের কিছু সময় তিন বছর বয়েসীদেরকে দুই বছর বয়েসীদের সাথে রাখা হত! কখনো তিন বছরের শিশুকে চার বছর বয়েসীদের সাথে রাখা হতো। মানে ছোটদেরকে বড়দের সাথে, বড়দেরকে ছোটদের সাথে রাখা। -এটা কেন করা হতো?-বড়রা গত বছরগুলোতে যা শিখেছে, ছোটদেরকে সেটা খেলাধূলার ছলে শিখিয়ে দেবে। ছোটরা বড়দের কাছ থেকে শিখে নেবে। ছোটরা বড়দেরকে শ্রদ্ধা করবে। বড়রা ছোটদেরকে  করবে। 


☛ ৭: মেয়েদেরকে পাঁচ বছর বয়েস থেকেই ছেলেদের থেকে আলাদা করে ফেলা হতো। শিক্ষা থেকে শুরু করে সবই পৃথক। তবে ব্যতিক্রমী নিয়মও ছিল। -সেটা কী?-এখনো পর্দা ফরয হয়নি, দেখা দেয়া জায়েজ, এমন ছেলেমেয়েকেও সপ্তাহের একটা সময় একসাথে রাখা হতো। -কেন? -ছেলেরা বাইরে ঘোরার সুযোগ পায়। মেয়েরা এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকে। ছেলে মেয়ে একদম পৃথক শিক্ষা-ব্যবস্থা হলে, পুরুষের কিছু অভিজ্ঞতা থেকে মেয়েরা বঞ্চিত থেকে যায়। আবার একটা মেয়ের সাথে কেমন আচরণ করবে এটাও ছেলেদের শেখা উচিত। সুস্থ সুন্দর গড়ে তোলার জন্যে নারী ও পুরুষের পারস্পরিক এই লেনদেনটা জরুরী। হারারেতে এটা ছিল সম্পূর্ণ শরীয়তসম্মতভাবে। পর্দা করার বয়েস হয়ে গেলে, আর মিশতে দেয়া হত না। 


☛ ৭: আরেকটা নিয়মও বিস্ময়কর ছিল। এখানে বিয়ের বয়েস হলেই বিয়ে করিয়ে দেয়া হত। দেখা যেত ছেলে ও মেয়ে দু’জনেই এখনো পড়াই শেষ করেনি, অথচ তাদের সন্তান হয়ে গেছে। এ-পদ্ধতির কারণে হারারী সমাজে গুনাহের পরিমাণ ছিল না বললেই চলে। 


☛ ৮: ছয় সাত বা আট বছর থেকেই মেয়েদেরকে আলাদা মাদরাসায় দেয়া হত। আবাসিক অনাবাসিক দুই পদ্ধতির মহিলা মাদরাসাই ছিল। মাদরাসা বলতে প্রচলিত স্কুল সিস্টেমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মতো ছিল না সেগুলো। 


☛ ৯: মাদরাসাগুলোকে বলা হত, ‘মাদরাসাতুল উম্ম’। মায়েদের মাদরাসা। আসলেও মায়েদের মাদরাসাই ছিল। বইপত্র পড়ানোর চেয়ে মৌখিক ও ব্যবহারিক শিক্ষাই ছিল প্রধান। আর মাদরাসার পড়াশোনা শ্রেণীভিত্তিক ছিল না, ছিল বিষয়ভিত্তিক। পড়ার বিষয়ও খুব বেশি ছিল না। কুরআন কারীম। হাদীস শরীফ। নারী বিষয়ক ফিকহ। আকীদা। সীরাত। মহীয়সীদের জীবনী। 


☛ ১০: পরীক্ষা খুব বেশি গুরুত্ব পেত না। একটা বিষয়ে দক্ষ হয়েছে কি না, সেটা যাচাই হয়ে যেত, নিজের চেয়ে ছোটদেরকে পড়াতে গিয়ে। প্রতিটি ছাত্রীই একই সাথে শিক্ষার্থী ও শিক্ষিকা। তাদের পড়ার বিষয় ছিল কম। তাই প্রতিটি বিষয় খুবই ভালভাবে আয়ত্ত হয়ে যেত। একটা বিষয় ভাললাগে আয়ত্ত না হলে, আরেকটা বিষয়ে জোর দেয়া হত না। মাদরাসাতুল উম্মে গ্র্যাজুয়েশন পদ্ধতি ছিল না। মানে এসএসসি, অনার্স, মাস্টার্স এমন পরিভাষা ছিল না। তাদের মধ্যে ছিল কুরআনের হাফেজা। বুখারী শরীফের হাফেযা। এ-ধরনের পরিভাষাতেই তাদের শিক্ষা আর যোগ্যতাকে সংজ্ঞায়িত করা হত। 


☛ ১১: সংসারে কাজে লাগবে এমন বিষয়গুলোর প্রতি বেশি জোর দেয়া হত স্কুলে। সেলাই। রান্নাবান্না। রাগদমন। ধৈর্য-সবর। পর্দাপুশিদা। স্বামীভক্তি। শ্বশুর-শাশুড়ির প্রতি শ্রদ্ধা। সন্তান লালনপালন ইত্যাদি। 


☛ ১২: মাদরাসাতুল উম্ম-এর ছাত্রীরা নির্দিষ্ট একটা সময় কাটাতো নাম্বারধারী বাড়িগুলোতে। অভিজ্ঞ মহিলাদের সাথে থেকে ছেলে-মেয়েদেরকে পড়াতো। কিছু সময় কাটাতো ‘সূতিকাগারগুলোতে’। নবজাতকের প্রতিপালন পদ্ধতি হাতেকলমে শিখতে। 


☛ ১৩: হারারি মুসলিম সমাজে একাধিক বিয়েরও বেশ প্রচলন ছিল। মেয়েরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে স্বামীকে বিয়ে করতে উদ্বুদ্ধ করত। তাদেরকে মাদরাসা থেকেই এ-ব্যাপারে যাবতীয় দিকনির্দেশনা দিয়ে দেয়া হত। তাদের মন-মানসিকতা তৈরী করে দেয়া হত। সব পুরুষই একাধিক বিয়ে করত এমন নয়। বহু বিয়ের প্রথা সচল থাকার কারণে, ঘরে নারীরা সাংসারিক কাজ, সন্তান লালন পালন ও স্বামীর সেবায় চাপমুক্ত থাকতে পারত। পাশাপাশি পুরুষরাও পাপচিন্তা থেকে বেঁচে থাকতে পারত। এক বিবি সংসারের কাজে থাকলে বাকি বিবিরা শিক্ষার কাজে নিয়োজিত থাকত। 


☛ ১৪: হারারী মুসলিম মেয়েদের উল্লেখযোগ্য কীর্তি হল, তাদের হস্তলিখিত কুরআন শরীফ, হাদীসের কেতাবাদি ও অন্যান কিতাব। হারারে যত কিতাবাদি পড়ানো হত, সবই আসত মেয়েদের পক্ষ থেকে। প্রতিটি ঘরেই মেয়েরা দিনের একটা অংশ কাটাত কুরআন কারীম লিখে। মেয়েদের হাতের লেখার শিল্পটা উৎকর্ষের চরম শিখরে আরোহণ করেছিল। হারারের বিভিন্ন লাইব্রেরী দেখলে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। 


-আচ্ছা দাদু, আপনাদের গার্লস স্কুলটাও কি এমন ছিল? -প্রথম প্রথম ছিল না। পরের দিকে প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহনের পর আমরা চেষ্টা করেছিলাম পুরনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু সম্রাটের বিধিনিষেধের কারণে হয়ে উঠছিল না। চার্চও বিষয়টাকে ভালভাবে নিতো না। তাই আমরা মধ্যমপন্থা ধরে এগুচ্ছিলাম। ...

(আগামীকাল শেষপর্ব। ইনশাআল্লাহ)