Monday, 30 October 2017

রেসিডেন্সিয়াল গার্লসস্কুল ইন হারার (শেষপব)

রেসিডেন্সিয়াল গার্লসস্কুল ইন হারার (শেষপব)!




writer-- atikullah
-
-আপনাদের বিয়েটা কখন হল? 

-ও সেটা শোনার জন্যে বুঝি আর তর সইছে না? আমরা যখন কানাডা থেকে এলাম, তিনি কিছুদিন নিরুদ্দেশ ছিলেন। পরে বলেছেন, হারারের বাইরে এক পাহাড়ে একজন শায়খ থাকেন। তার কাছে গিয়েছিনে দ্বীনের ভুলে যাওয়া বিষয়গুলো নতুন করে শিখে নিতে। পাহাড়বাস থেকে ফেরার পর, খেয়াল করলাম তিনি আমার মুখোমুখি না হয়ে শুধু পালাই পালাই করে বেড়াচ্ছেন। অবাক হয়ে একদিন মুখোমুখি হলাম। তিনি বললেন:
-দেখ, তুমি ইসলাম সম্পর্কে মোটামুটি জেনেছ। আমি বাইরে খ্রিস্টান হলেও, ভেতরে ভেতরে মুসলিম,সেটাও জান। এটাও জান, ইসলামী শরীয়ত মতে আমাদের একসাথে কাজ করা বৈধ নয়। এতদিন করেছি বিপদের আশংকায়। প্রাণনাশের আশংকা ছিল। এখনো আছে। কিন্তু তুমি আমাকে অন্য কাজ দাও। সেখানে মেয়েদের সাথে একসাথে কাজ করতে হবে না।
-এ সমস্যার সমাধান অন্যভাবে করা যায় না?
-কিভাবে? মিস জুলির ব্যাপারে যেভাবে করেছিলেন?
-নাহ ওটা সম্ভব নয়!
-কেন সম্ভব নয়? যা হয়েছে, তারপর আমার আর বিয়ে করা চলে না!
-কেন? ইসলামে নিষেধ আছে?
-না, তা কেন থাকবে!
-তাহলে?
-প্রথমত অন্য কোনও নারীর প্রতি আগ্রহ খুঁজে পাই না। আর সব সময় জুলির কথা মনে পড়ে। এমতাবস্থায় আরেকজনকে বিয়ে করলে, তার প্রতি সুবিচার করতে পারব না। কেন জেনেশুনে একজনের সাথে বেইনসাফি করতে যাবো? আর আরেকটা বিষয় তুমি বুঝতে পারছ না!
-কোন বিষয়টা?
-আমি তোমার চেয়ে কত বড় সেটা হিশেব করে দেখেছ?
-সে তো কবেই দেখেছি! যেদিন মিস জুলির হারিয়ে যাওয়ার সংবাদ পেলাম সেদিনই। আসলে বলা ভাল, যেদিন প্রথমবার আপনাদের দু’জনকে চার্চের পাশের ঘরে একান্ত নিবিড় হয়ে সূরা ফাতিহা পড়তে দেখেছি সেদিন থেকেই!
-কী বলছ তুমি?
-আমরা রেসি স্কুলে থাকতে মনে করতাম, পুরুষ মানেই বর্বর! জানোয়ার! কারণ ফাদার থেকে শুরু করে দারোয়ান মালি পর্যন্ত সবাই আমাদের সাথে অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করতো। আপনাদের দু’জনকে দেখার আগে, একজন পুরুষ একটি মেয়ের সাথে এতটা মমতা দিয়ে কথা বলছে, এটা জানা ছিল না। কল্পনায়ও ছিল না।
-তুমি তখন কিশোরী ছিলে! মনটাও নরম ছিল! মনে রঙ ধরতে শুরু করছিল। সেটা ছিল প্রথম ভাল লাগা! তাই আমার অন্য কিছু বা বাস্তবতা তোমার চোখে পড়ছে না।
-চোখে না পড়লে না পড়–ক! আমি অন্ধ হয়েই থাকতে চাই! মিস জুলি হারিয়ে যাওয়ার পরই আমি ঠিক করেছিলাম, বাকি যে কোনও মূলে আপনার সাথেই থাকব! আমি নিয়মিত ঈশ^রের কাছে প্রার্থনা করে এসেছি এজন্য। এমনকি আপনার ও মিস জুলির ‘আল্লাহর’ কাছেও আমি নিয়মিত প্রার্থনা করেছি।
-এটা কিন্তু তোমার বোকামি! আরও ভেবে দেখ! বিয়েটা হলে তুমি কতকিছু হারাবে? চার্চ থেকে বহিষ্কৃত হবে! বন্দী হওয়াও বিচিত্র কিছু নয়!
-মরে গেলেও আমার আপত্তি নেই।
-তুমি জেনেশুনে আগুনে ঝাঁপ দিতে চাইলে, আমার কীইবা করার আছে!
.
-তাহলে এরপরই বিয়ে হয়ে গেল?
-জি¦। প্রথমে গোপন ছিল। নিরাপত্তার স্বার্থে। এমনিতেই চার্চের লোকজন আমাদেরকে সন্দেহ করতে শুরু করেছিল। সত্তরের দশকের মাঝামাঝিতে যখন সম্রাট হাইলে সেলাসির ক্ষমতা কমে আসছিল তখন থেকে আমরা আস্তে আস্তে চার্চ থেকে আলাদা হতে শুরু করেছি। ১৯৭৪ সালে সম্রাটকে গদিচ্যুত করা হয়। তার পরপরই আমরা প্রকাশ্যে ইসলামের ঘোষণা দিয়েছি। আমাদের স্কুলকেও পুরোপুরি চার্চ থেকে আলাদা করে ফেলেছি। স্কুলের জায়গা ছিল বিলালের দাদুর। তাই চার্চ কোনও আইনি ব্যবস্থা নিতে পারেনি। ভ্যাটিকানও নাক গলাতে চেয়েছিল। কিন্তু সম্রাটকে হটিয়ে ক্ষমতা দখলকারী আমান মীকাঈল আনডন ও তাকে হটিয়ে ক্ষমতা দখলকারী মঙ্গেসতু হাইলে মরিয়াম (১৯৭৪-১৯৯১) ছিলো কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন। মঙ্গেসটু দেশ থেকে ইসলাম ধর্ম পালনের বিধিনিষেধ তুলে দিয়েছিল। আমাদের কাজ অনেক সহজ হয়ে গিয়েছিল!
.
-দাদু, আপনার স্কুল কি এখন সেই আগের যুগের মতো চলছে?
-তা কি আর হয়? সম্রাটের চার দশকব্যাপী দমন-পীড়নের কারণে হারার সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছিল। লোকজনের মধ্যে বিধর্মীদের প্রভাব ঢুকে পড়েছিলা পুরোমাত্রায়। আগের সমস্ত মূল্যবোধ ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল। যুবকশ্রেণী নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। তারা দিনরাত আলকাত (Khat)-এর নেশায় ডুবে ঝিমুতো। সম্রাটও আলকাতের চাষ বাড়াতে এখানকার চাষীদেরকে উৎসাহিত করতো। তার উদ্দেশ্য ছিল, এখানকার যুবকশ্রেনীকে নেশায় ডুবিয়ে রাখা। সম্রাটের উদ্দেশ্য অনেকটাই সফল হয়েছিল। আগে এই শহরকে বলা হত, মদীনাতুল ইলমি ওয়াল ওলামা। আলেমদের শহর। এখন বলা হয়, মদীনাতুল জুহহাল।


 নিরক্ষর অজ্ঞদের শহর। সম্রাটের পরিকল্পিত সংস্কৃতিক আগ্রাসন একটা জনপদকে হাজার বছর পিছিয়ে দিয়েছে। হারারে ইসলাম এসেছিল আরব ব্যবসায়ীদের হাত ধরে। ভিন্নমতে নবীজি সা.-এর যুগেই ইসলাম এসেছিল এখানে। সাহাবায়ে কেরাম সাগর পথে মক্কা থেকে হিজরত ইরিত্রিয়া উপকূলে অবতরণ করেছিলেন। সেখান থেকে ইসলাম ক্রমান্বয়ে আদ্দিস আবাবা হয়ে হারারে এসেছিল। হারারে ইসলামের পুনর্জাগরণ হয়েছিল ১৫২০ খ্রিস্টাব্দে। ইমাম আহমাদ বিন ইবরাহীম রহ.-এর নেতৃত্বে। তিনি আরব থেকে এসে এখানকার মুসলমানদেরকে একত্রিত করে শক্তিশালী মুসলিম সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদে তিনি শহীদ হলেন ১৫৪৩ সালে। তার পরে সা¤্রাজ্যের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন আমীর নূর মুজাহিদ। তিনি ছিলেন ইমাম আহমাদ বিন ইবরাহীমের ভাগ্নে। তাকেই হারারের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। তার শাসনামলেই হারার পরিণত হয়েছিল ইলম ও জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রাণকেন্দ্রে। 

আমীর নূর মুজাহিদ হারার শাসন করেছিলেন ১৫৬৯ সাল পর্যন্ত। এখনো হারারে তার বংশধররা বাস করে। হারারের ঘরবাড়িগুলো আজো আগের মতো ইসলামী রীতিতে নির্মিত হয়। সর্বত্র ইসলামি সভ্যতার ছাপ। রাস্তাঘাট, নগরপ্রাচীর, ঘরবাড়ি সবকিছুতে। আমীর নূর মুজাহিদ গোটা হারার শহরকে প্রাচীর দিয়ে পরিবেষ্টিত করেন। পুরো শহরটা এখনো প্রাচীর বেষ্টিত। শুধু হারার শহর প্রাচীরের মধ্যেই মসজিদ ছিল ৯৩টা। বেশির ভাগই নির্মিত হয়েছিল খ্রিস্টিয় দশম শতাব্দীর আগে। 

-দাদু, আমি প্রাচীরটা দেখতে চাই!
-ঠিক আছে। আস্তে আস্তে সবই দেখবে। হারারের সর্বশেষ আমীর ছিলেন আবদুল্লাহ। তার শাসন শেষ হয়েছিল ১৮৮৭ সালে। তারপর হারার খ্রিস্টানদের হাতে চলে যায়। ইতালিয়ানরাও কিছুদিন হারার শাসন করেছিল। হারারে ইউরোপিয়ান কারো প্রবেশ করা নিষিদ্ধ ছিল। প্রথম ১৮৫২ সালে প্রথমবারের মতো একজন ইউরোপিয়ান হারারে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়। সে লোকটি ছিল বিৃটিশ গোয়েন্দা রিচার্ড ব্র্র্যাটন। আরব মুসলিম ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশ ধারন করে সে ধোঁকা দিয়ে শহরে প্রবেশ করেছিল। রিচার্ড অনর্গল আরবীতে কথা বলতে পারত। এই ব্রিটিশ চরই পরে হারার সম্পর্কে লেখালেখি করেছিল। তার লেখার সূত্র ধরে সবার লোলুপ দৃষ্টি পড়েছিল হারারের উপর। দীর্ঘকাল ধরে ইথিওপিয়ান সা¤্রাজ্য ও হারারের ইসলামি সালতানাত পাশাপাশি বাস করে আসছিল। ইথিওপিয়ার ইউহানেস চতুর্থ (১৮৭১-১৮৮৯) হারার দখল করে নেয় ১৮৮৭ সালে। আচ্ছা, অনেক কথা হল, এখন বল আগামীকাল প্রথমে কী দেখতে যাবে?
-লাইব্রেরী!
-বাহ, খুব ভাল! তোমাকে আমি শায়খ শরীফের লাইব্রেরিতে নিয়ে যাব প্রথমে। সেখানে প্রায় এগারশ বছরের পুরনো কুরআনের নুসখা আছে। হাতে লেখা। এবং সেটা এখানকার মেয়েরাই লিখেছে। সেই মাদরাসাতুল উম্ম-এর প্রথম দিককার কোনও এক ছাত্রী। কী সুন্দরই না হয়েছে সেটা, দেখলে বুঝতে পারবে! কুরআন শরীফটা হাতে নিলে তোমার বিশ^াস করতে কষ্ট হবে, সেটা কোনও এক মেয়ের হাতের লেখা!
-দাদু, আমার কী ইচ্ছে করছে জানো?
-কী?
-তোমার স্কুলে ভর্তি হয়ে যেতে! তোমার কাছে থেকে যেতে!
-বিশে^র সেরা স্কুল ফেলে হারারের এই ঘুপচির স্কুল ভাল লাগবে বুঝি?
-তুমি যেভাবে স্কুলের ইতিহাস বললে, সত্যি সত্যিই লোভ জাগছে! আমি বড় হলে এমন একটা স্কুল খুলব! দেখে নিও!
-আচ্ছা, সে সময় হলে দেখা যাবে! 

.
তিনদিন পর জুমাইমা চলে গেল। আঙ্কল একজন লোক পাঠিয়েছিলেন নিয়ে যাওয়ার জন্যে। জুমাইমা আরও থাকতে চেয়েছিল। সে দাদুর স্কুল (মাদরাসা) নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করতে শুরু করে গিয়েছিল। দাদুকে তার এত ভাল লেগেছে, সে সব ছেড়েছুড়ে দাদুর কাছে থেকে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু তা কী করে হয়! সে চলে যাওয়াতে দাদু ভীষণ একা হয়ে গেলেন। কয়টা দিন তার কথা বলার সঙ্গী পেয়ে সময়গুলো ভালোই কেটেছিল। আমি আরও কিছুদিন দাদুর কাছে থাকলাম। দাদুকে একাকী রেখে আদ্দিসআবাবায় যেতে মন চাচ্ছিল না। আঙ্কল রোনে এর মধ্যে দু’বার ফোন করেছেন। তাড়াতাড়ি চলে যেতে বলেছেন। দাদুও বারবার তাগাদা দিচ্ছিলেন। অগত্যা বের হতে হল। দাদুকে ছেড়ে যেতে মনটা কিছুতেই সায় দিচ্ছিল না। না গিয়েও উপায় নেই। শেষ পরীক্ষাটা দিতে হবে। আদ্দিসআবাবায় পৌঁছার পর শুনলাম, জুমাইমা মা-বাবার কাছেও বলেছে সে আর ফিরে যাবে না। দাদুর কাছে থেকে যাবে। তার সাথে থেকে পড়বে ও গার্লস স্কুলের ছাত্রীদের মতো নিজেকে গড়ে তুলবে! আঙ্কল মেয়ের গাগলামি দেখে মিটিমিটি হেসেছেন। শুধু বলেছেন,
-ওটা তো মুসলিমদের!

-নাহ, ক্রিশ্চান মেয়েরাও পড়ে। মুসলিম ও ক্রিশ্চানদের আলাদা আলাদা সিলেবাস।
এবার আন্টি মুখ খুললেন। শক্ত কণ্ঠে বললেন, তুমি কানাডাতেই পড়বে। এবং পড়াশোনা শেষ করার আগে আর এখানে আসারও দরকার নেই। তোমার আব্বুও বদলি হয়ে যাবেন আগামী বছর। মাথা থেকে এসব ভূত নামাও। মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়ায় কর। আগামী সপ্তাহেই তুমি ফিরে যাবে। টিকেট কাটা হয়ে গেছে।
.
জুমাইমা এবার আমাকে ধরল। আমিও আন্টির মতো কঠিন অবস্থান নিলাম। আর যাই হোক, আমি কিছু বললে, জুমাইমা সেটা বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিত। এবার একটু দোনোমনো করলেও মেনে নিয়েছে। সে ইউরোপিয় ঘরানার মেয়ে হলেও মন-মানসিকতা পুরোপুরি ইউরোপিয় পায়নি। এটা কি শৈশব-কৈশোর কানাডার বাইরে আফ্রিকার মাটিতে কাটানের ফল? কে জানে, হতেও পারে। আমি পরীক্ষার প্রস্তুতিতে ডুবে গেলাম। দিনরাত, আশপাশ সবকিছু ভুলে গেলাম। দাদুর কথাও সব সময় মনে ছিল না। ভেতরে কোত্থেকে একটা জেদ এসে গিয়েছিল। আমাকে পরীক্ষায় ভাল করতে হবে। মেডিকেলে ভর্তি হতে হবে। 
পুরো হারার শহরে একজনও মুসলিম ডাক্তার নেই। চার্চের ডাক্তার দিয়ে কাজ চালাতে হয়। মিশনারী ডাক্তারগুলো পুরোমাত্রায় এ শূন্যস্থানের সুযোগ নিতে কসুর করে না। আমি একজন ডাক্তার হতে পারলে, আমার দেখাদেখি অন্যরাও সাহস পাবে। আরও আগেই মুসলিম ডাক্তার বেরিয়ে আসত! হারারের আলিমগণের ভুল সিদ্ধান্ত সবাইকে ভোগাচ্ছে। তারা সবাইকে বুঝিয়েছেন, এসব পড়াশোনা খ্রিস্টানদের বিষয়। মুসলিম ছেলেরা পড়তে গেলে ঈমান থাকবে না। খ্রিস্টান হয়ে যাবে নয়তো নাস্তিক হয়ে যাবে। মুসলিম ছেলেরা শুধু কুরআন কারীম ও হাদীস শরীফ নিয়ে থাকবে!
-তাহলে চিকিৎসাসহ অন্য প্রয়োজন কিভাবে পুরো হবে?
-আল্লাহ তা‘আলা খ্রিস্টান ও বিধর্মীদেরকে আমাদের কাজে নিয়োজিত করে দেবেন!
-পর্দানশীন নারীদের চিকিৎসা কিভাবে হবে?
-শরীয়ত লঙ্ঘন করে চিকিৎসার কী প্রয়োজন?
.
এই ছিল তাদের চিন্তা। নিজেদের বদ্ধ চিন্তাকে দ্বীনের নামে চালিয়ে দিতো। এদিকে মুসলমানরা খ্রিস্টান ডাক্তারদের ফাঁদে পা দিয়ে দলে দলে খ্রিস্টান হয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ ধর্মান্তরিত না হলেও, মতান্তরিত হয়ে যাচ্ছে। তারা শত বছরের ধর্মীয় ঐতিহ্যকে অস্বীকার করে ধর্মমুক্ত জীবন যাপনে উদ্বুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। মেয়েরা দলে দলে অন্য শহরে গিয়ে কফি হাউজ আর বারে চাকুরি নিচ্ছে। অবস্থা বেগতিক দেখে, দাদাভাই, আব্বুসহ অভিজ্ঞরা বৈঠকে মিলিত হলেন। দাদু গার্লস স্কুলের মতো বয়েস স্কুল খোলার প্রতি গুরুত্ব দিলেন। 

অথবা ধর্মীয় মাদরাসাগুলোর সিলেবাসকে ঢেলে সাজানোর পরামর্শ দিলেন। তা যদি সম্ভব না হয়, অন্তত উল্টাপাল্টা ফতোয়া না দেয়া হয়, সেটা নিশ্চিত করা। মানুষকে বিভ্রান্ত করে এমন কথা যেন কোনও ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব থেকে না আসে। যারা এ-ধরনের উল্টাপাল্টা ফতোয়া দেয়, তাদের প্রায় সবাই বলতে গেলে ধর্ম সম্পর্কে কোনও জ্ঞানই রাখে না। তাদের কুরআন পড়াও শুদ্ধ নেই। দশকের পর দশক খ্রিস্টানদের চাপিয়ে দেয়া আগ্রাসনে সুষ্ঠু ধর্মীয় ব্যাহত হয়ে যাওয়াতেই সমস্যাগুলোর সৃষ্টি হয়েছে। অর্ধশিক্ষিত বা নামমাত্র শিক্ষিত মানুষগুলোই আলিম পরিচিতি পেয়ে যাওয়াতে সমস্যা তৈরী হয়েছে। ক্রমশ স্থবির হয়ে আসা হারারের মুসলিম জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করতে হলে, দ্বীন ও দুনিয়া উভয় ঘরানার শিক্ষা নিয়ে আসতে হবে বাইরে থেকে। এখানকার সবকিছুতে জড়তা ধরেছে।
.
জুমাইমা আজ চলে যাবে। সে এয়ারপোর্টে যাওয়ার আগেও বলে গেছে, তার যেতে ইচ্ছে করছে না। আমি কিছু বলিনি। একবার ভেবেছিলাম, জুমাইমা চলে যাওয়ার আগে বাসায় থাকব না। তার ব্যাপারটা আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। সে কেন থাকার জন্যে এমন গোঁ ধরে আছে? ব্যাপারটা নিয়ে বেশি ভাবার ফুরসত মিলল না। পরীক্ষা এসে চলেও গেল। আমার পাশে সিট পড়েছিল একজন ইরিত্রিয়ানের। আসা-যাওয়ার পথে কথা বলতে বলতে মোটামুটি একটা সম্পর্ক গড়ে উঠল। পরীক্ষা শেষ হওয়ার দু’দিন আগে সে প্রস্তাব দিল,
-আমাদের বাড়িতে বেড়াতে যাবে?
-ইরিত্রিয়ায়?
-জি¦।
-কিন্তু ওখানে তো যুদ্ধ লেগেই আছে।
-তুমি জানো, আমরা যুদ্ধ করতে চাইনি, আমাদের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। হাইলে সেলাস দীর্ঘ শাসনামলে (১৯৩০-১৯৭৪) পুরো সা¤্রাজ্য জুড়ে মুসলমানদের উপর চরম দমন পীড়ন চালিয়েছিল। এই অত্যাচারী মুসলিম বিদ্বেষী স¤্রাট আক্রোশবশত ১৯৫২ সালে আমাদের ইরিত্রিয়া দখল করে নিয়েছিল। ইথিওপিয়া অন্যায়ভাবে আমাদের দেশ দখল করে নিয়েছে। তুমি জানো ইরিত্রিয়ার বেশির ভাগ অধিবাসী মুসলমান। বিধর্মীয় কোনও বাহিনী মুসলিম ভূমি দখল করে নিলে, প্রতিরোধ গড়ে তোলা ফরয হয়ে যায়। আমরা ফরয আদায় করছি মাত্র। তুমি গেলে আমি খুশি হব। আমাদের কষ্টগুলো কাছে থেকে দেখে আসবে। তোমাদের হারারের উপরও আদ্দিস আবাবা দীঘদিন ধরে দমননীতি গ্রহণ করে আসছে। আমাদের ওখানটা ঘুরে এলে তুমিও হারার সম্পর্কে নতুন কোনও চিন্তার দিগন্ত পাবে!
-আমি দাদুর অনুমতি ছাড়া যেতে পারব না!
-আমি পরীক্ষা শেষ হলেই চলে যাব! তুমি দাদুর সাথে দেখা করতে গেলে, আমাকে অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়।
-আচ্ছা, পরীক্ষা শেষ হলে দেখা যাবে।
.
বেশি চিন্তা না করে ইরিত্রিয়া যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। দাদুকে জানাবনা ঠিক করেছি। জানতে পারলে তিনি যেতে নাও দিতে পারেন। আঙ্কলকে জানাব কি জানাব না দোটানায় পড়ে গেলাম। শেষমূহুর্তে সিদ্ধান্ত নিলাম, বাড়ি যাচ্ছি ভাব নিয়ে আঙ্কল আন্টির কাছ থেকে বিদায় নেব। বন্ধুর বাড়ি রাজধানি আসমারার শহরতলিতে। দাদুর আব্বুও এখানে এসেছিলেন। ইতালিয়ানদের বিরুদ্ধে জিহাদে অংশ নিতে। এবার আমি এলাম। ইরিত্রিয়ার প্রতি আমাদের হারারী মুসলমানদের জন্মগন টান। এ দেশ সাহাবায়ে কেরামের স্মৃতি বিজড়িত।

চারদিকে ঘোরা শেষ হল। রাজধানীর বাইরেও যাবো বলে স্থির করলাম। হাতে সময় আছে অল্প ক’টা দিন। এরপর বন্ধু তার কাজে চলে যাবে। আমাকে সময় দিতে পারবে না। আমারও বেড়ানো শেষ হয়ে গেছে। ফিরে যাওয়ার বন্দোবস্তি শুরু করে দিলাম। এমনি কথাচ্ছলে জানতে চাইলাম,
-তুমি কোন কাজে যাবে?
-আছে একটা। তোমাকে বলা যাবে না!
-বলোই না, গুরুত্বপূর্ণ কিছু হলে, আমিও তোমার সাথে যাবো!
-আমি সীমান্তে যাচ্ছি। ওখানে মুজাহিদ বাহিনীর সাথে যোগ দেব। ইথিওপিয়ার জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।
-আমিও যাবো। নেবে?
-নতুন কাউকে নিতে হলে ছাড়পত্র নিতে হয়। আমি আগামীকাল যোগাযোগ করে তোমাকে জানাব। আশা করি পেয়ে যাব। তোমার সম্পর্কে আগেও আমীর সাহেবকে জানিয়েছি।
বাড়ি যাচ্ছি না দেখে দাদু চিন্তা করবেন। কিভাবে তার কাছে খবরটা পৌঁছানো যায় ভাবছি। সরাসরি বললে, সরকারি গোয়েন্দারা জেনে যাবে। এমনিতেই সরকার মুসলমানদেরকে সন্দেহের চোখে দেখে। ইরিত্রিয়ায় আক্রমণ করার পর সন্দেহের মাত্রা আরও বহুগুণ বেড়ে গেছে। সমস্যাটা বন্ধুকে জানালাম। সে হেসেই উড়িয়ে দিল।
-ও এই কথা! তুমি মোটেও চিন্তা করো না। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই তোমার দাদুকে জানানোর ব্যবস্থা করছি!
-কিভাবে?
-পুরো ইথিওপিয়াতেই আমাদের লোকজন আছে। তোমাদের হারারেও আছে। কী জানাতে হবে বলো!
-শুধু জানাতে হবে, আমি ভাল আছি। একজায়গায় বেড়াতে এসেছি। ফিরে গিয়ে বিস্তারিত বলব। বিশেষ কারণবশত বলে আসা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি।
-তোমার দাদু কি বেশি বৃদ্ধ? মানে তোমার সাহায্য ছাড়া চলতে পারেন না এমন?

-নাহ! আমার দাদু এখনো পুরোপুরি শক্ত ও কর্মঠ। চব্বিশ ঘণ্টাই কোনও না কোনও কাজে ব্যস্ত। ছাত্রী পড়াচ্ছেন। ছাত্রীদের রান্নাবান্না তদারক করছেন। আমি না হলেও তার অগণিত ছাত্রী আছে। তারা তাকে মাথায় করে রাখে। দাদাভাই শহীদ হওয়ার পর বুকভাঙা শোকও তিনি ছাত্রীদের সযত পরিচর্যায় কাটিয়ে উঠেছিলেন। তিনি মানুষটা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের। তিনটা সম্পূর্ণ ভিন্ন সভ্যতাকে বুকে ধারন করে আছেন। জন্মসূত্রে পেয়েছেন রেড ইন্ডিয়ান সভ্যতা। বেড়ে ওঠা ও লেখাপড়ার সূত্রে পেয়েছেন ইউরোপিয়ান সভ্যতা। 
দাম্পত্য ও কর্মজীবনের সূত্রে পেয়েছেন আফ্রিকান সভ্যতা। দাদুর চিন্তা কতটা স্বচ্ছ আর বাস্তবসম্মত একটা ঘটনা বললেই পরিষ্কার হবে! গাড়ি দুর্ঘটনায় পরিবারে প্রায় সবাই মারা যাওয়ার পর আমি বাড়ি গিয়েছি। দাদুকে দেখে অবাক। তিনি সারাক্ষণই কাঁদছেন কিন্তু কাজেকর্মে কথাবার্তায় তার কান্নার কোনও প্রভাবই পড়তে দেননি। আগের রুটিনেই স্বাভাবিক ছন্দে দৈনন্দিন কাজ চালিয়ে গেছেন।
-তাকে একবার দেখার বড় সাধ জাগছে।
-তিনি তোমার সাথে দেখা দেবেন না।
-কথাও বলবেন না?
-জি¦, বলবেন।
-তাহলেই হবে। তার কাছে আমার অনেক কিছু জানার আছে। প্রশ্ন করার আছে।
-ঠিক আছে, হায়াতে বেঁচে থাকলে তোমাকে নিয়ে যাবো। ইনশাআল্লাহ।

শুরু হল নতুন জীবন। প্রশিক্ষণপর্ব দ্রুত সমাাপ্ত হল। সরাসরি জিহাদের ময়দানে অবতীর্ণ হলাম এক ভোরে। মধ্যরাতে তাহাজ্জুদ পড়ে রওয়ানা দিলাম, বহুদূরের পায়ে হাঁটা পথ। পাহাড় ডিঙ্গাতে হবে কয়েকটা। নিজের জীবনকে এতদিনে সার্থক মনে হচ্ছিল। যুগে যুগে হকের ঝা-া উঁচিয়ে ধরা দলের নগন্য একজন সদস্য হতে পেরে মনটা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতায় নুয়ে আসছিল। প্রতি রাতেই কোনও না কোনও ফ্রন্টে লড়াই চলত। 

এ ছিল এক অসম যুদ্ধ। ইথিওপিয়ার সাথে ছিল আমেরিকা ব্রিটেনের মতো বড় বড় শক্তি। আমাদের সাথে আরবের সামান্য অর্থ সাহায্য। আল্লাহ তা‘আলার প্রতি আনুগত্য আর আমাদের প্রতি তার অশেষ করুণাই ছিল আমাদের প্রধান পাথেয়। এত আত্মত্যাগ আর কুরবানির মধ্যেও একটা বিষয় মনে সারাক্ষণ খচখচ করে বিঁধত।
 ইরিত্রিয়ার পক্ষে বিভিন্ন দল লড়ছে, প্রায় সবাই জিহাদের আদর্শ নিয়ে লড়ছে না। তারা লড়ছে জাতীয়তাবাদ আর ভূরাজনৈতিক আদর্শে প্রভাবিত হয়ে সংকীর্ণ মানচিত্রের মোহে। তাদের একটা জাতীয় পতাকা হবে। তাদের একটি স্বতন্ত্র মানচিত্র হবে। তাদের একটি পার্লামেন্ট হবে। তারাও অন্যদের মতো জাতিসংঘের সদস্য হবে। তারাও ওআইসির সদস্য হবে। তারাও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংঘের সদস্য হবে। এই নিয়ে সুখস্বপ্নে বিভোর থাকত। ইসলাম ও শরীয়াহ নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা ছিল না। তাদের আদর্শ কমুনিজমঘেঁষা ধর্মনিরপেক্ষ শাসনব্যস্থা। 

আমাদের দলটা এখন লড়ছে মুয়সাওয়া (গধংংধধি) শহরে। দেখতে দেখতে অনেক দিন হয়ে গেল ময়দানে এসেছি। জিহাদের ময়দানে একবার এলে বাড়িঘরে ফিরতে মন চায় না। সারাক্ষণ শুধুই জান্নাতের চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকে মাথায়। শাহাদাতের সুতীব্র নেশায় পেয়ে বসে। মুজাহিদ বাহিনী তাদের ঘাঁটি হিশেবে মুসাওয়া শহরকে বেছে নেয়ার একটা কারণ আছে। সাহাবায়ে কেরামের প্রথম দলটি হিজরত করে দীর্ঘ মরু ও সাগরপথ পাড়ি দিয়ে এই মুসাওয়াতেই অবতরণ করেছিলেন। ইসলামের প্রথম মসজিদও এই শহরেই স্থাপিত হয়েছিল। মসজিদটি রাসে মুদার (رأس مدر) নামে পরিচিত। সাহাবায়ে কেরামের হাতে। 
তারা হিজরত করেছিলেন হিজরতের আট বছর আগে রজব মাসে। ৬১৪ খ্রিস্টাব্দে। কত আগের ঘটনা, মনে হয় এই তো সেদিনের কথা। আমি কল্পনার চোখে দেখতে পাচ্ছি, সাহাবায়ে কেরাম নৌকা থেকে নামছে। একজন উম্মুল মুমিনীনও আছেন! আরও কত দৃশ্য ভাসছে। সাহাবায়ে কেরামের পদধূলির বরকতে এখানে স্বাধীন এক মুসলিম সালতানাত গড়ে উঠেছিল। সাগর পেরিয়ে মিসরের আসওয়ান পর্যন্ত এর সীমানা বিস্তৃত ছিল। ৯২৩ সালে তুর্কি সুলতান সলীম এ-সালতানাতকে উসমানি খিলাফার অধীনে নিয়ে যান।

আমাদের মুজাহিদ বাহিনী মরণপণ লড়াই চালিয়ে যেতে লাগলেন। যুদ্ধের মোড় আস্তে আস্তে ঘুরতে লাগল। ইথিওপিয়া আলোচনায় বসতে সম্মত হল। আমাদেরকে ছাড়াই বৈঠক শুরু হল। মুজাহিদ বাহিনী কোনও প্রকারের আলোচনার পক্ষপাতিও ছিল না। ইরিত্রিয়া স্বাধীন হল। ক্ষোভে দুঃখে সবাই চুল ছেঁড়ার উপক্রম। এতদিন আমরা লড়লাম। আমাদের দলের বাইরের দলগুলোতে অন্য শিরোণামে সাধারণ মুসলমানরা লড়ল। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে বসল একজন কমুনিস্ট অর্থোডক্স খ্রিস্টান। আসিয়াস আফওয়ার্কি। মুজাহিদ বাহিনীতে দ্বিধা তৈরী হল। লড়াই চালিয়ে যাবে নাকি আপাতত রণে ভঙ্গ দিবে। লড়াই চালিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। তাহলে আমাদেরকে লড়তে হবে এখন দুই শত্রুর সাথে। ইথিওপিয়া ও ইরিত্রিয়ান সৈন্যদের সাথে। এতদিন যাদের সাথে মিলে শত্রু তাড়িয়েছি এখন তাদের দিকে বন্দুক তাক করতে হবে। কী করা যায়, সিদ্ধান্তে পৌঁছা যাচ্ছিল না। চিন্তা চললেও, সীমান্তে ইথিওপিয়ান বাহিনীর বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলছিল। 

এর মধ্যে পেরিয়ে গেছে একটা বছর। দাদুকে নিয়মিত খবর পাঠিয়েছি। লোক মারফত জানিয়েছি, কোথায় আছি, কী করছি! আমাকে নিয়ে দাদু কী ভাবছেন সেটা জানার কোনও উপায় ছিল না। দিনদিন অবস্থা আরও করুণ হয়ে উঠছে। চারদিক থেকে ঘেরাওয়ের মধ্যে আছি। খাবারের সংকট দেখা দিল। অস্ত্রও প্রায় ফুরিয়ে গেছে। প্রেসিডেন্ট আসিয়াস আমাদেরকে অস্ত্র সংবরণ করতে অনুরোধ করলেন। নইলে কঠোর ব্যবস্থার হুমকি দিলেন। আমরা ছোট্ট জায়গার মধ্যে ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে গেলাম। আামাদের সামনে তিনটা পথ খোলা রইল:

১: আত্মসমর্পন।
২: সরকারী বাহিনীতে যোগদান।
৩: ঘেরাও ভেঙে কৌশলে চোখে ধূলো দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া। পরে সুযোগ বুঝে প্রস্তুতি নিয়ে আবার ময়দানে ফেরা।
পরামর্শে শেষটা প্রাধান্য পেতে লাগল। আমীর সাহেব বারবার বৈঠকে বসছেন। সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না। একরাতে, আমরা গোপন শেল্টারে বসে আছি। আমীর সাহেব এসে বললেন, তোমার সাথে এক ভদ্রলোক দেখা করতে এসেছেন। আমি অবাক, এখানে কে আসবে? কে আসতে পারে? ভাবতে ভাবতে মাথা ব্যথা হয়ে গেল, কূলকিনারা করতে পারলাম না। কোনও হদিস বের হল না। বাংকার ছেড়ে বাইরে এলাম। আমীর সাহেবের সাথে অনেকক্ষণ হাঁটার পর বড় রাস্তার পাশের এক ছোট্ট গলিপথে নামলাম। ঘুটঘুটে অন্ধকারেও আবছা আবছা দেখতে পেতাম। ময়দানে থাকার সুফল। সামনে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আমীর সাহেব আমাকে রেখে চলে গেলেন। দ্বিধা নিয়ে গাড়ির কাছে গেলাম। কাছে যেতেই চালকের দরজা খুলে গেল। দীর্ঘকায় একজন মানুষ নামলেন গাড়ি থেকে। আরেকটু যেতেই চমকে গেলাম। আঙ্কল রোনে। আকাশ থেকে পড়ার মত অবস্থা! তিনি এখানে? অসম্ভব!
-কেমন আছ ‘সন’?

-ভাল আছি! আপনি কেমন আছে? আন্টি কেমন আছেন? আর জুমাইমা?
-সবাই ভাল আছে। আমি তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি!
-আপনি এখানে কিভাবে এলেন?
-সেটা পরে শুনো!
-এখন আমার সাথে চলো! গাড়িতে উঠো!
-কিন্তু আপনার সাথে আমার যাওয়া সম্ভব নয়। আমরা একটা কাজে আছি!
-আমি সব জানি! সবদিকে খোঁজখবর করে তবেই তোমাকে নিতে এসেছি!
-আমি আমার দলের সাথে বেঈমানি করতে পারব না। আমার আদর্শের সাথে বেঈমানি করতে পারব না।
-সেসব কিছুই করতে হবে না। আচ্ছা, এদিকে এসো।
অঙ্কল আমার হাত ধরে গাড়ির পেছনের দরজার কাছে নিয়ে দাঁড় করিয়ে বললেন:
-তোমরা কথা বল। আমি আসছি।
বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছি। পেছনের দরজা খুলে গেল। সালামের শব্দ শুনে চমকে উঠলাম,
-জুমাইমা?
-জি¦, আমি।
-স্বপ্ন দেখছি নাতো! তুমি তুমি এখানে কী করে এলে?
-সে অনেক কথা! আপনি আমাদের সাথে চলুন। আপনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে আমি সেই টরেন্টো থেকে ছুটে এসেছি।
-না জুমাইমা তা হয় না।
-কেন হয় না?
-আমাকে কাপুরুষ হতে বলছ? বেঈমান হতে বলছ?
-জি¦ না। আমি আপনাকে সব সময় বীরপুরুষ এবং ঈমানদার হিশেবেই কল্পনা করি। অতীতেও করেছি। ভবিষ্যতেও করে যাব। আমি একা ফিরে গেলে দাদু ভীষন কষ্ট পাবেন। তিনিই বড়মুখ করে আমাকে পাঠিয়েছেন। কেন পাঠিয়েছেন বুঝতে পারছি না। আমি বললেই আপনি আমার কথা ধরে ফিরে যাবেন, এটা বিশ^াস হতে চায়নি। তবুও দাদু অভিজ্ঞ মানুষ। তার কথা খুব কমই ভুল হতে দেখেছি।
-তুমি আমাকে দ্বিধায় ফেলে দিলে দেখছি!
-আপনি আপনার আমীর সাহেবের সাথে কথা বলে আসুন। নিজেকে বেঈমান আর কাপুরুষ মনে হবে না।
-বা রে, বেশ প্রস্তুতি নিয়েই এসেছ দেখছি! আর তুমি এত সমঝদার কী করে হয়ে গেলে? দেড় বছরের মধ্যে এমন মুরুব্বি হয়ে গেলে?
-দাদুর সাথে থেকে থেকে!

-তোমার কথাবার্তা রহস্যময় হয়ে উঠছে। আচ্ছা, আমি আমীর সাহেবের সাথে কথা বলি।
আমীর সাহেব কাছেই ছিলেন। আমাকে রেখে চলে যান নি। আঙ্কলের সাথে কথা বলছিলেন। তিনি বললেন:
-বেলাল, সিদ্ধান্তটা সঠিক হচ্ছে কি না জানি না। আমাকে তোমরা সিদ্ধান্তের ভার দিয়েছ। আমি অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করেছি, আপাতত আমাদের দলটা ভেঙে দেব। এই ভদ্রলোক আমাদের জন্যে সাগরপথে বেরিয়ে যাওয়ার একটা এস্কেপ রুট ঠিক করেছেন।
-আমাকে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছেন তাহলে?
-জি¦, চলে যাও। ইনশাআল্লাহ শিঘ্রিই আমাদের আবার দেখা হবে। আমরা আগামীতে আবার মিলিত হবো আজকের আরদ্ধ কাজকে এগিয়ে নেয়ার জন্যে। 

.
চলে এলাম। গাড়িতে চুপচাপ বসে আছি। গাড়ি ছুটে চলছে আসমারার দিকে। অসহ্য নিরবতা ভাঙলেন আঙ্কল।
-তোমার কি মন খারাপ?
-এখনো ঠিক বুঝতে পারছি না! ভেতরটা অনুভূতিশূন্য। কিভাবে কী হল, খুলে বলুন তো?
-ঘটনা বেশি নেই। দেশ স্বাধীন হল, তুমি বেঁচে আছ, তারপরও বাড়ি ফিরছ না, তাই তোমার দাদু উদ্বিঘœ হয়ে উঠলেন। তোমার দাদুর সাথে জুমাইমার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। তোমার নিরুদ্দেশ হওয়ার সংবাদ শুনে আমরা সবাই মুষড়ে পড়েছিলাম। সরকারী কোনও সংস্থা তোমাকে উঠিয়ে নিল কি না, ব্যাক্তিগত কানেকশন কাজে লাগিয়ে খোঁজ নিলাম। পরে তোমার দাদুই খবর পাঠাল ভাল আছ। জুমাইমাও সামারের ছুটিতে বেড়াতে এসেছিল ওর মায়ের কড়া নিষেধাজ্ঞা ঠেলে। মেয়ে থাকবে বাবা-মায়ের কাছে, তা না করে, সে দু’টা দিন থেকেই হারার ছুটল। তোমার দাদু কী জাদু করেছেন কে জানে! পুরো ছুটিই ওখানে কাটিয়েছে। বাধ্য হয়ে তোমার আন্টিও ওখানে কিছুদিন থেকে এসেছে। তারপর থেকে তোমার আন্টির মুখ থেকেও তোমার দাদুর প্রশংসা বের হতে শুরু করল। আগে নিজেই মেয়েকে বাধা দিত। এখন আমিই বাধা দিয়ে রাখতে পারি না। কিছুদিন পরপরই সে হারার ছুটে যায়।
-আপনাদের সবার প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা। দাদুকে দেখে রেখেছেন।
-কী বলছ তুমি, আমরা তোমার দাদুকে দেখে রাখব কি, উল্টো উনিই আমাদের সবাইকে দেখে চোখে রেখেছেন।
-এক বছর পর আপনার বদলির কথা ছিল।
-জি¦। আমাকে ইরিত্রিয়ায় বদলি করা হয়েছে। এতদাঞ্চল সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতার কথা মনে রেখেই হয়ত কৃর্তপক্ষ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি চেয়েছিলাম কানাডা ফিরে যেতে। টানাহ্যাঁচড়ার কারণে জুমাইমার লেখাপড়া হচ্ছে না ঠিকমত। তা হল না। 

-আমার অবস্থান কিভাবে বের করলেন?
-তোমার দাদু জুমাইমাকে চিঠি লিখেছিল, আমাকেও লিখেছিল, তোমাকে ফিরিয়ে নেয়ার কোনও ব্যবস্থা করতে। বিশেষ করে জুমাইমাকে বলেছিল। জুমাইমার অনুরোধ নাকি তুমি ফেলতে পারবে না। তাই শুধু তোমার জন্যে আমি তাকে কানাডা থেকে উড়িয়ে এনেছি। তোমার দাদীমার কথা ফেলি কী করে! তিনি আমাদের কানাডার গর্ব। তার মতো মেয়ে আমাদের দেশে জন্ম নিয়েছে, ভাবতেই ভাল লাগে।
-এখানে এলেন কিভাবে?
-আমি প্রথমেই বিভিন্ট ফ্রন্টে খোঁজ লাগালাম। খবর বের করতে দেরী হল না। তারপর লোক পাঠিয়ে তোমার আমীরের সাথে যোগাযোগ করলাম। তাকে পরিস্থিতি বুঝিয়ে বললাম। তোমাদের দল তৎপরতা বন্ধ না করলে ভয়ংকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে, সেটাও বললাম। এখন যুদ্ধকৌশলে পরিবর্তন আনতে হবে, এটা বুঝিয়ে বলেছি তোমার আমীরকে।
-কারা সেই পরিস্থিতি তৈরী করবে?
-ইসরায়েল ও আমেরিকা।
-ইহুদিরা এখানে কিভাবে এল?

-তোমরা ফ্রন্টে থেকে কোনও খোঁজই রাখ না। এখনকার দিনে শুধু ফ্রন্টলাইনে যুদ্ধ করলেই চলে না ইয়ংম্যান! চারদিকেও চোখ রাখতে হয়। চট করে কেন ইথিওপিয়া স্বাধীনতা দিতে রাজী হল? এতদিন ধরে যুদ্ধ চালাল, আরও চালাতে পারত! আসলে পর্দার আড়ালে কিছু খেলা হয়ে গেছে। ইরিত্রিয়া মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। কিন্তু দেশের প্রধান একজন খ্রিস্টান! এটা হয়েছে গোপন সমঝোতা চুক্তির আওতায়। সমঝোতা হতেই স্বাধীনতা পেয়ে গেল। স্বাধীনতার পর প্রথম স্বীকৃতিও কিন্তু ইসরাইল দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট আসিয়াসের প্রথম বিদেশ সফরও ইসরায়েলে।
-এই গরীব দেশে ইসরাঈল কী পাবে?

-অনেক কিছুই পাবে। ইরিত্রিয়ার অধীনে অনেক দ্বীপ পড়েছে। তার মধ্যে দুটি দ্বীপ ইতিমধ্যেই ইসরায়েলের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। একটাতে ইসরায়েল সামরিক বেস স্থাপনের কাজ শুরু করেছে আরেকটাতে চাষাবাদ। রাজধানী আসমারাকে ইতালিয়ানরা দ্বিতীয় রোম বলত। রোমের মত করেই গড়ে তুলেছিল তারা এ শহরকে। এখন সে রোম হয়েছে মোসাদের অভয়ারণ্য। মুসলমানদের মাদরাসাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ইতিমধেত্য প্রায় বিশ হাজারেরও বেশি মুসলিম স্কলারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আগে আরবী এখানকার প্রধান ভাষা ছিল। সব জায়গা থেকে আরবীকে হটিয়ে দেয়ার কাজ শুরু হয়েছে। ইরিত্রিয়া আফ্রিকা ও আরবের সংযোগসেতু। এটা দখলে রাখতে পারলে, অনেক লাভ। সামরিক ও অর্থনীতি ভূরাজনীতি সবদিক থেকে। ইসরাঈল এই লাভের প্রায় পুরোটাই নিজের পকেটে পুরতে সক্ষম হয়েছে।

আসমারা থেকে সোজা দাদুর কাছে চলে এলাম। দীর্ঘ প্রায় দেড় বছর পর দাদুর সাথে দেখা। জন্মের পর থেকে এত দীর্ঘ সময় কখনো দাদুকে ছেড়ে ছিলাম না। আদ্দিস আবাবায় থাকতেও না। আগে দাদুকে জানাইনি আমি আসছি। হঠাৎ করে জাজ¦ল্যমান আমাকে দেখে দাদু বাকহারা হয়ে গেলেন। দু’চোখের তারায় ফুটে উঠল ভীষণ খুশির ঝিলিক। এগিয়ে আসে হাত ধরলেন। দাদুকে কখনো মাত্রাতিরিক্ত আবেগ করতে দেখিনি। আজ একটু বেসামাল হয়ে গেলেন। বুঝতে পারলাম, তার প্রতি সত্যি সত্যি অন্যায় করে ফেলেছি। সবাইকে হারিয়ে ভীষণ একা হয়ে গেছিলেন, তারপর আমিও উধাও হয়ে গেলাম। দাদুর পুরো জীবনটাই এভাবে কেটেছে। অনেক কথা জমেছে! সবার আগে জানতে চাইলেন,
-জুমাইমা গিয়েছিল তোকে আনতে?
-জি¦।
-ও কি চলে কানাডা চলে গেছে?
-জি¦ না।
-কবে যাবে বলেছে কিছু?
-তাও বলেনি। ও আমার সাথে কথাই বলেনি। এটা রাগ না অভিমান নাকি অন্য কিছু বুঝতে পারিনি।
-পাগলি মেয়ে অভিমান করেছে। এভাবে কেউ হারিয়ে যায়? যাক, আমি খুশি হয়েছি, তুই অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে গিয়েছিস। লেখাপড়ায় দুই বছর পিছিয়ে পড়লি। এখন লেখাপড়ায় মন দে।
-আর লেখাপড়া মন বসবে? কতদিন হল বইখাতার সাথে সম্পর্ক নেই!
-এটা বুঝি একজন বুঝদার মানুষের কথা হল?
-কী পড়বো? কোথায় পড়বো?

-পরীক্ষার ফলাফল কেমন হয়েছে, সেটাও তো জানতে পারনি। আশাতীত ভাল করেছ। রাজধানিতে গিয়ে দেখ, কোথায় ভর্তি হওয়া যায়। তোমাকে যে কোনও মূল্যে ডাক্তার হতেই হবে। হারারে একজন মুসলিম ডাক্তার কত বেশি জরুরী, বলে বোঝানো যাবে না। তুই কয়েকদিন দেখ, তাহলে বুঝতে পারবি। একজন মহিলা ডাক্তারও প্রয়োজন। আমি জুমাইমাকেও বলেছি, ডাক্তারি পড়তে!
-সে ডাক্তারি পড়লে হারারের কী লাভ হবে?
-লাভ হবে কি হবে না, সেটা ভবিষ্যতে বোঝা যাবে। আল্লাহ তা‘আলার দরবারে অসম্ভব কিছু আছে? তিনি চাইলে দিনকে রাত করতে পারেন! তোর কাজ তুই কর, জুমাইমারটা আমি দেখব।
-আচ্ছা, আমি না থাকাবস্থায় সে নাকি গ্রীষ্মের ছুটি পুরোটাই তোমার এখানে কাটিয়েছে? কী করেছিল সে?
-কী করেনি? পড়েছে। পড়িয়েছে। আমার সাথে গল্প করেছে। কাজ করেছে। রুগিদের সেবা করেছে। চিকিৎসা করেছে।
-সে ডাক্তারি পারে?

-আমি শিখিয়ে দিয়েছি। সে থাকাতে অনেক উপকার হয়েছে। আমার মেয়েরা বেশ উৎসাহ পেয়েছে। তারা একজন শাদা মানুষের সাথে অকপটে মিশতে পেরে আনন্দিত হয়েছে।
-দাদু, একটা প্রশ্ন সব সময় মনের মধ্যে ঘুরপাক খেয়ে বেড়ায়। দাদাভাই মারা গেলেন, আগে ও পরে প্রায় সবাই চলে গেলেন, তোমার কষ্ট লাগে না?
-তুই আছিস, জুমাইমা আছে। এর বেশি আর কী চাই? আর কষ্ট? দেখছিস না কষ্টগুলো কিভাবে চোখের পানি হয়ে হু হু করে বেরিয়ে আসছে? তারা চলে গেছেন। তাই বলে জীবন কি থেমে থাকবে? সেই একদম দুধের বয়েস থেকেই তো একের পর এক হারিয়ে আসছি।
-দাদাভাইয়ের অভাব অনুভব করো না?

-এমন একটা মুহূর্তও নেই, তাকে অনুভব করিনি। তিনি আমার কাছে কী ছিলেন, বলে বোঝাতে পারব না। তিনি আমার শুধু স্বামী ছিলেন না। তিনি আমার বন্ধু ছিলেন, বাবার মতো ছিলেন, বড় ভাইয়ের মতো ছিলেন, পথ প্রদর্শকের মতো ছিলেন, শিক্ষকের মতো ছিলেন। তিনিই আমার প্রথম ও শেষ পুরুষ। সবচেয়ে বড় কথা আমি তার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলাকে পেয়েছি। ঈমান পেয়েছি। ইসলাম পেয়েছি। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পেয়েছি। কুরআন কারীম পেয়েছি। সেই সাতসমুদ্র তের নদী পেরিয়ে সুদূর আফ্রিকায় বাস করার হিম্মত পেয়েছি।

এক সপ্তাহ পরে আঙ্কল রোনে আমাকে আদ্দিস আবাবা যেতে বললেন। তিনি আসমারা থেকে সেখানে এসেছেন। তার সাথে দেখা করলাম। জুমাইমাও তার সাথে এসেছিল। এসে শুনি সে দাদুর সাথে দেখা করতে গেছে। আঙ্কল বললেন:
-আমি তিনদিনের জন্যে সরকারি এক কাজে এসের্ছি। আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি, এবছর আর মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার সময় নেই। মাত্র একমাস আগেই ভর্তি শেষ হয়েছে। ভাবলাম, এ-সময়টা বসে বসে নষ্ট না করে, কিছু একটা করো।
-কী করতে পারি?

-আমার মাথায় একটা পরিকল্পনা এসেছে। তুমি জানো কি না জানি না। ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সে পুরো কর্তৃত্ব ছিল আমেরিকার হাতে। ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত সব বিমান কেনা হয়েছে আমেরিকা থেকে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করছিলাম, ইথিওপিয়ার কাছে বিমান বিক্রি করতে। কিন্তু এয়ারলাইন্সের বড় বড় পদগুলোতে ছিল মার্কিন কর্মকর্তা। সত্তর দশকের মাঝামাঝিতে এসে বিমানসংস্থার নিয়ন্ত্রণ ইথিওপিয়ানদের হাতে আসে। এবার আমাদের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টা সফল হল। ১৯৭৫ সালে তাদের কাছে একটা বিমন বিক্রি করতে সক্ষম হই। সে থেকে শুরু। আজো অটুট আছে। দূতাবাসে আমার দায়িত্ব হল, বিমান ও পরিবহনের দিকটা দেখা। যাতে কানাডার তৈরী প্রডাক্ট ইথিওপিয়ার বাজারে জনপ্রিয় করে তোলা যায়। এরই প্রেক্ষিতে আমি কিছু প্রস্তাবনা দিয়েছি রাষ্ট্রদূত মহোদয়ের কাছে। তার মধ্যে একটা ছিল, আমার জন্যে একজন এদেশীয় প্রতিনিধি নিয়োগ করা। আমি তোমার নাম প্রস্তাব করেছি। তুমি কি কাজটা করবে?
-আপনি বললে করবো! তবে আমার ইচ্ছা ছিল, দাদুর সাথে থাকার!
-ভাল কথা। আমি চিন্তা করেছি, তুমি যদি পড়াশোনাটা কানাডাতে গিয়ে করতে, তাহলে ভাল হত। এই চাকুরিটা করলে, তোমার পড়াশোনার খরচা উঠে আসবে। আর কানাডা সরকারের অধীনে কাজ করার কারণে, ভিসা পাওয়াও সহজ হবে।
-আপনি আমার আর দাদুর জন্যে অনেক চিন্তা করেন। সেই কবে থেকে আপনার সাহায্যই পেয়ে আসছি। 

-তোমার এসব নিয়ে ভাবার প্রয়োজন নেই। তোমার জীবনে উন্নতি হোক, এটাই আমার কামনা। তোমার দাদু চান, তুমি একজন যোগ্য ডাক্তার হও। তোমার হারারের কল্যানের জন্যেই তিনিই এটা চান। অসহায় গরীব মানুষগুলোর চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্যে। তোমার দাদু আমাকে বারবার করে বলেছেন, আমি যেন তোমার লেখাপড়ার দিকটা দেখি।
-ঠিক আছে আঙ্কল, আমি চাকুরিটা করব।
-তাহলে তুমি গোছগাছ করে আগামী সপ্তাহে চলে আস। আমি সব ঠিকঠাক করে যাব। আর জুমাইমাকে সময়মত বিমানে তুলে দিও।

হারারে ফিরে এলাম। দাদু সারাক্ষণ জুমাইমাকে নিয়েই ব্যস্ত। আমার দিকে ফিরে তাকানোরও ফুরসত নেই। দেখতেই অবাক লাগছে, জুমাইমাকে দেখে মনেই হয় না, সে একজন খ্রিস্টান মেয়ে। দিব্যি দাদুর সাথে সব কাজে অংশ নিচ্ছে। ছায়ার মতো দাদুর সাথে লেপ্টে আছে। দাদু শুধু একবার জানতে চেয়েছেন, জুমাইমাকে তোর কেমন লাগে? আমি উত্তর দিলাম,
-সে ভালো মেয়ে। তাকে ভাল না লেগে উপায় নেই।
-সে চায় তোর সাথে থেকে যেতে!
-সে কি করে সম্ভব?
- বোকা ছেলে, সম্ভব করার দায়িত্ব আমার। আমি বলি কি, তুই একবার তার সাথে কথা বলে দেখ! ও তোর সম্পর্কে কী ভাবে জেনে নে!
-ঠিক বলেছ দাদু, জুমাইমার সাথে আমার একবার বসা দরকার। ওর আচরণগুলো দিনদিন রহস্যময় হয়ে উঠছে। সে যদি অন্যরকম কিছু ভাবে, তাহলে তার ও আমার উভয়ের সমস্যা। সে যদি সব সমস্যার কথা জানার পরও আগে বাড়তে চায়, আমার আপত্তি নেই।

দাদু জুমাইমাকে ডাকতে গেলেন। আমি বসে বসে ভাবতে লাগলাম। জীবন নিয়ে কত কি ভেবে ভেবে হয়রান ছিলাম, এখন জীবন বইছে কোন খাতে। আমার জীবনের লাগাম আমার হাতে নেই। ময়দানে থাকতে কল্পনা করতাম, আর কখনো বের হবো না, শহীদ হওয়া পর্যন্ত একটানা আল্লাহর রাস্তায় লেগেই থাকব। শহীদ হওয়ার আশায় ইরিত্রিয়া স্বাধীন হওয়ার পর মাটি কামড়ে পড়ে রইলাম। কিন্তু কুদরতের ফয়সালা ছিল ভিন্ন। আল্লাহ তা‘আলা হয়তো অন্যভাবে কাজ নেয়ার ফয়সালা করে রেখেছেন। আচ্ছা, আমি কি ময়দান ছেড়ে পালিয়ে এসেছি? নাহ, তা কি করে হয়। আমাদের পিছিয়ে আসা ছাড়া অন্য কোনও উপায় ছিল না। অস্ত্র নেই, খাবার নেই, সামনে শত্রুও নেই। এমতাবস্থায় কিভাবে যুদ্ধ করি? কার সাথে করি? আর পিছিয়ে আসা হয়েছে, সর্বসম্মত পরামর্শক্রমে। এটা নিয়ে মনে কোনও ধরনের গ্লানি থাকা উচিত নয়। 

আমার এখন হারারকে নিয়ে ভাবতে হবে। এখানকার শিক্ষা, চিকিৎসা, মূল্যবোধ নিয়ে। কিভাবে হারারকে আদ্দিসআবাবার খ্রিস্টান বলয় থেকে বের করে, আগের নিষ্কলুষ ইসলামি ভাবধারায় ফিরিয়ে আনা যায়, তার জন্যে কাজ করতে হবে। যেসব মেয়েরা হারার ছেড়ে চলে গেছে, জীবিকার নাম করে, তাদেরকে ঘরে ফেরানোর যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। এখানেই তাদের জন্যে সম্মানজনক আর্থিক বন্দোবস্তি করতে হবে। তাদেরকে আগের মতো শিক্ষাব্রতী করে তুলতে হবে। এখানেই একটা মেডিকেল কলেজ স্থাপনের চেষ্টা করতে হবে। দাদু থাকতে থাকতে, দাদুর গড়ে তোলা ছাত্রীদেরকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে দিতে হবে। তারা যেন প্রত্যেকে সুগৃহিনী হতে পারে, তার জন্যে উপযুক্ত পাত্র দেখে বিয়ে দিতে হবে। এমন সুযোগ্য পাত্রীদের যারা পাত্র হবে, তারাও যেন কিছুটা যোগ্যতা অর্জন করে সংসারধর্ম শুরু করতে পারে, তার উদ্যোগ নিতে হবে। কত কাজ! আরে বসে বসে ভাবছি, দাদু এলেন না যে এখনো? জুমাইমা আসতে রাজি হচ্ছে না? কথা বলতে আগ্রহী নয়?
-দাদুউউউ! ও দাদুউউ!

-এই তো আসছি! জুমাইমা এইমাত্র স্কুল থেকে ফিরল। ভীষণ ক্লান্ত। এ-অবস্থায় তোর সাথে বসতে লজ্জা পাচ্ছে। আর এখন মানসিকভাবে প্রস্তুত নয় বলছে।
-আচ্ছা, ঠিক আছে। তুমিই কিন্তু আগে বেড়ে উৎসাহ দেখাচ্ছ। পরে ভিন্ন কিছু হলে আমার দোষ নেই।
-তুই একটা বুদ্ধু! জুমাইমার মতো একটা মেয়ে বুঝি আমার মতো বুড়ির কাছে থাকতে আসে? হোক না বয়েস কম, তুই ওর সাথে কখনো কথা বলে দেখলে বুঝতে পারবি, বয়েসের তুলনাত সে কতটা অগ্রসর! তার ভাগ্যটা আসলেই ভাল। অত্যন্ত ভাল বাবা-মা পেয়েছে। তারপর শিক্ষক হিশেবে পেল তোকে।
-আমি তাকে আর কিইবা শিখিয়েছি! সেই উল্টো আমাকে শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছে। 

-নাহ, সে তোর কাছেই প্রথম শালীনতা শিখেছে। চলাফেরায় পরিমিতিবোধ শিখেছে। বাবামাকে শ্রদ্ধা করার শিক্ষা পেয়েছে। সেই ছোট বয়েসেই নিজেকে রেখেঢেকে রাখতে শিখেছে। অপ্রয়োজনে সময় নষ্ট না করে, মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করতে শিখেছে। স্কুলে পেয়েছে সুদানী বান্ধবী। তার প্রভাবও জুমাইমার জীবনে অনস্বীকার্য। কানাডায় পেয়েছে এক পাকিস্তানি শিক্ষিকা। সবমিলিয়ে আল্লাহ তা‘আলা তার প্রতি খাস রহমত নাযিল করেছেন। আমি প্রথম দিন ওর সাথে কথা বলেই বুঝতে পেরেছিলাম, সে আর দশজন ইউরোপিয়ান মেয়ের মতো নয়। তাদের মতো হলে, সে তোকে ও আমাকে সান্ত¡না দেয়ার জন্যে এতদূর ছুটে আসত না। ওর সাথে কথা বললে, সে তোকে জানাবে। আমি সব জানিয়ে দিলে, পরের মজা নষ্ট হয়ে যাবে। 

-দাদু, আমি পরীক্ষার পর না আসাতে তুমি কিভাবে ওর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেছিলে?
-আমি করিনি। সেই অগ্রণী হয়ে আমার সাথে যোগাযোগ করেছিল। সে চিঠি লিখেছিল তার বাবার কাছে। তার বাবা আমার কাছে পাঠিয়েছে। আমি মনে মনে তার সঙ্গ কামনা করছিলাম। এমন সময় তার চিঠি হাতে পেয়েছিলাম। তারপর থেকে আমিও লিখেছি সেও লিখেছে। চিঠির মাধ্যমে দু’জনের মধ্যে একটা অসম বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। তাকে চিঠি লেখাটা নেশার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তোকে চিঠিগুলো দেখাব। সে আমাকে লিখত সে কী পড়ছে, কি শিখছে, কি জানছে, কি দেখছে, কি ভাবছে! আমি তাকে লিখে জানাতাম কি শিখেছি শিখছি, কি ভেবেছি ভাবছি, কি জেনেছি জানছি, কি দেখেছি দেখছি! আমার চিঠিগুলো পড়ে ও যেমন অনেক কিছু জানতে পারতো, আমিও তার চিঠি পড়ে অনেক কিছু জানতে পারতাম। শিখতে পারতাম। উন্মুক্ত পৃথিবীর সন্ধান পেতাম। এমনকি তোদের সংবাদও পেতাম তার কাছ থেকে!
-আমাদের সংবাদ? কিভাবে?

-আমি তাকে চিঠিতে জানিয়েছিলাম, তুই ইরিত্রিয়া গিয়েছিস। ইথিওপিয়ার জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে! বিশ^াস করবি না, জুমাইমা ব্যাপারটাতে এত বেশি মুগ্ধ হয়েছিল, পারলে সেও তৎক্ষণাত তোর সাথে যোগ দেয়ার জন্যে ইরিত্রিয়া চলে যায় যায় অবস্থা। সে বাবার মাধ্যমে ও এক মহিলা সাংবাদিকের মাধ্যমে নিয়মিত ইরিত্রিয়ার সংবাদ রাখতে শুরু করল। যা জানত, সাথে সাথে আমাকে লিখে জানাত। কানাডার এক পত্রিকায় সে নিয়মিত ইরিত্রিয়া বিষয়ক লিখতেও শুরু করেছিল ছদ্মনামে। ওটা নিয়েও মজার ঘটনা। সম্পাদক ভেবেছিল বড় বয়েসের কেউ লিখছে। পরে খোঁজ নিয়ে আসল মানুষের হদিস উদ্ধার করে তো তারা থ’। এই মেয়ে এত দূরদৃষ্টি কিভাবে পেল? কোথায় কানাডায় বসে সুদূর ইরিত্রিয়ার ফ্রন্টলাইনের তরতাজা খবর সংগ্রহ করছে। আবার ব্যক্তিগত বিশ্লেষণও দিচ্ছে! 

তুই ময়দানে থাকাবস্থায় সে বেড়াতে এসেছিল। ইরিত্রিয়ায়। সেই মহিলা সাংবাদিকের সাথে সে ফ্রন্ট লাইনেও চলে গিয়েছিল। চুরি করে। বাবা-মায়ের অগোচরে। কেন গিয়েছিল বুঝতেই পারছিস। তোকে খোঁজার জন্যে। যদিও বাবা-মাকে বলেছে, সে ভবিষ্যতে ডাক্তারি পেশার পাশাপাশি শখের সাংবাদিক হবে, তাই একজন অভিজ্ঞ সাংবাদিকের সাথে হাতেকলমে শিখতে গিয়েছে। সে মহিলা সাংবাদিকও টের পায়নি জুমাইমা তার সাথে সাথে এতদূর গিয়েছে।
-এ তো ভীষণ দস্যি মেয়ে দেখছি! 

-এ আর দস্যিপনার কি দেখছি! ও যেসব দুঃসাহসিক ভাবনা ভাবে, সেসব জানতে পারলে, আমার মনে হয় তুই তার ত্রিসীমানায়ও ঘেঁষতে চাইবি না। তার মা আমার কাছে আক্ষেপ করে বলেছে, তার মেয়েটা কেন যে এমন বেয়াড়া হয়ে বেড়ে উঠল! ডরভয় কিছুই নেই। তবে বেয়াদব নয়। মায়ের কথা মন দিয়ে চুপটি করে শোনে। কোনও বিষয়ে মায়ের সাথে একমত হতে না পারলে, ঠা-া মাথায় যুক্তি দিয়ে মাকে নিজের মতে এনে ছাড়ে। মেয়ের উসীলায় বাবা ও মা উভয়েই এখন হেদায়াতের প্রায় কাছাকাছি। আগে জুমাইমার মা বোধ হয় আমাদেরকে পছন্দ করতো না, কিন্তু মেয়েকে দিনদিন ভালো হতে দেখে, মাও আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এখানে এসে থেকে গেছে। আমাদের স্কুলে শ্রম দিয়ে গেছে। ছাত্রীদের সাথে সময় কাটিয়ে গেছে। আমাদের স্কুলের মেয়েদের সাথে সময় কাটালে, যে কারও ভাল লাগবে।
-দাদু, আমি জুমাইমার সাথে এখন আর বসতে চাই না।
-কেন?
-আগে আঙ্কলের মতামতটা জেনে নিই। তারপর।
-সেটা নিয়ে তোর ভাবতে হবে না। কানাডার বিয়ের বয়েস আঠার। তার অপেক্ষায় আছি। সময় হলে আমি প্রস্তাব দেব। রাজি না হলে, তখন দেখা যাবে। অবশ্য বিশেষ ব্যবস্থায় ষোল হলেও নাকি বিয়ের একটা ব্যবস্থা কানাডার আইনে আছে।
-সেটা কাগজেকলমে বিয়ের বয়েস। এটা সম্পূর্ণ ইসলাম বিরোধী আইন।
-আচ্ছা, আমি জুমাইমার সাথে কথা বলে দেখি।
দু’জনে মুখোমুখি বসা আর হয়ে উঠল না। জুমাইমা চলে গেল। আমি আর দাদু আবার একা। চাকুরিতে যোগ দেয়ার সময় হল। আদ্দিসআবাবায় চলে এলাম। শুরু হল আমার চাকুরে জীবন। বেশিদিন চাকুরি কপালে ছিল না। সমস্যা দেখা দিল সম্পূর্ণ ভিন্ন দিক থেকে। চাকুরির তৃতীয় মাসে, আঙ্কল রোনে আদ্দিস আবাবায় এলেন। আমাকে ডেকে বললেন:
-ইথিওপিয়ার সরকার একটা তালিকা তৈরী করছে গোপনে।
-কিসের তালিকা?

-ইথিওপিয়া থেকে কারা কারা ইরিত্রিয়ার পক্ষে যুদ্ধ করেছে তাদের তালিকা।
-খুব সম্ভব তোমার নামও তালিকায় আছে। আমি জানতে পেরেছি এক জেনারেলের সূত্র ধরে। তিনি আমাদের কানাডার পক্ষে কাজ করেন। এখানকার সরকার যেন কানাডার বিমান ও পণ্য কেনে, এ-বিষয়ে লবিং করার দায়িত্ব তার। তালিকাটা চূড়ান্ত হতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে। বেশি সময় পাওয়া যাবে না।
-আমি এখন কী করতে পারি?
-বেঁচে থাকতে চাইলে খুব দ্রুত দেশত্যাগ করতে হবে।
-কিন্তু কোথায় যাব? ইরিত্রিয়া বা সুদান?
-ওদিকে গেলে সমস্যা দেখা দেবে! ভবিষ্যতে আর আইনসঙ্গতভাবে দেশে ঢুকতে পারবে না। তুমি খুব দ্রুত পাসপোর্ট করে ফেল।

বিমানে ওঠার আগেও ভাবতে পারিনি, শেষ পর্যন্ত আকাশে উড়তে পারব। বিমান যতক্ষন মাটিতে ছিল, ভয়ে ভয়ে ছিলাম, এই বুঝি ধরতে এল। এই বুঝি ফ্লাইট বাতিলের ঘোষণা এল। না, সেসবের কিছুই ঘটল না। বিমান নিরাপদেই আকাশে উড়াল দিল। বিমান এগিয়ে যাচ্ছে অসীম আকাশের দিকে। আমি এগিয়ে যাচ্ছি একটি সসীম স্বপ্নময় জীবনের দিকে। জুমাইমার মতো একটা মেয়েকে সাথে পেলে দুনিয়া জয় করে ফেলতে পারব। ইনশাআল্লাহ। এত সহজে দু’জন কাছাকাছি আসার সুযোগ পাব, কল্পনাতেও আসেনি। তাকে কাছে পাওয়ার জন্যে, নিজের জীবনসঙ্গী করে ঘরে তোলার জন্যে কতভাবে পরিকল্পনা সাজিয়েছি, কিন্তু কোনওটাই শেষ পর্যন্ত যুক্তিসঙ্গত মনে হত না। ছুঁড়ে ফেলে নতুন আরেক পরিকল্পনায় ডুবে যেতাম।
সেদিন আঙ্কলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, দ্রুত পাসপোর্ট অফিসে গেলাম। সাথে কানাডা দূতাবাসের সুপারিশ থাকাতে সবকিছু দ্রুত হয়ে গেল। সেই জেনারেলই আড়াল থেকে কলকাঠি নেড়ে যাবতীয় মুস্কিল আসান করে দিয়েছেন। পাসপোর্ট হওয়ার পর আঙ্কল আমাকে নিয়ে সোজা দাদুর কাছে গেলেন। তিনজন মিলে বৈঠকে বসলাম। দাদু সব জেনে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন।
- এখন কী হবে? আমাদের হারারের ভবিষ্যত পরিকল্পনার কী হবে?
-আপনি চিন্তা করবেন না। আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। ওকে কিছুদিনের জন্যে কানাডা পাঠিয়ে দিতে চাই! আপনার আপত্তি আছে?

-আমার কেন আপত্তি থাকবে? আগে পরে সে ডাক্তারি পড়ার জন্যে কানাডায় যাওয়ার কথাই ছিল।
-কিন্তু তার যাওয়াটা স্বাভাবিক হচ্ছে না। ধরপাকড় শুরু হলে, সে আর কখনো দেশে ফিরে আসতে পারবে না। আবার আমি তাকে কয়েক মাসের টুরিস্ট ভিসা সংগ্রহ করে দিতে পারব। কানাডা চলে যাওয়ার পর, চেষ্টা-তদ্বির করে কাজ করার অনুমতিও আদায় করে দিতে পারব! কিন্তু এদেশের সামরিক সরকার যদি কানাডা সরকারের কাছে আবেদন করে, আমাদের সরকার নিজেদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে, বিলালকে ইথিওপিয়ান কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেবে। এটা ঠেকানোর উপায় আমার জানা নেই। একটা উপায় হতে পারে, সে গোপনে আমেরিকা পালিয়ে গেল। কিন্তু হারার নিয়ে তার ভবিষ্যত পরিকল্পনা? এখানকার মানুষগুলো নিয়ে তার এতদিনের স্বপ্ন? সবই যে ব্যর্থ হয়ে যাবে?
-তাহলে উপায় কি?

-একটা উপায় অবশ্য আছে। তাকে কোনও উপায়ে কানাডার নাগরিকত্ব পাইয়ে দেয়া। কিন্তু এটা এত অল্প সময়ে সম্ভব নয়। অল্প সময়ে নাগরিকত্ব পেতে হলে ওখানকার কোনও মেয়েকে বিয়ে করতে হবে।
আঙ্কল কথা থামাতেই দাদু বললেন:
-রোনে, তুমি আমার একমাত্র নাতিকে বাঁচানোর জন্যে বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারবে না?
-কেন পারব না। অবশ্যই পারব।
-আমি যদি বলি, জুমাইমাকে আমরা পাত্রী হিশেবে চাই, তুমি কি রাগ করবে?
-কী বলছেন আপনি। আমরাও তাই চাই। জুমাইমার আম্মু আগে রাজি ছিল না। এখন আপনি জানেন, সেও আপনাকে অত্যন্ত পছন্দ করে।
-আলহামদুলিল্লাহ। আমার বুক থেকে বিরাট এক পাষাণ নেমে গেছে।

বিমান চলছে। আমিও চলছি। বিমান এগুচ্ছে তার গন্তব্যের দিকে। আমি এগুচ্ছি হৃদয়নোঙ্গরের দিকে। ভবিষ্যত পরিকল্পনাগুলো একে একে ভেসে উঠতে থাকল। দু’জনেই ডাক্তারি পড়লেও দু’জনের পড়ার বিষয় ভিন্ন হবে। সে মনোযোগ দেবে নারী বিষয়ক সমস্যাগুলোর দিকে। দু’জনে মিলে হারারকে গড়ে তুলব একটি সুন্দর জনপদে। আমাদের সন্তানরা বেড়ে উঠবে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকময় সমাজে। ইনশাআল্লাহ।

No comments:

Post a Comment