writer- atikullah... রেসিডেন্সিয়াল গার্লসস্কুল ইন হারার story part- 1
একটু পর বিমান ছাড়বে। যাত্রা বহুদূরের। সেই পৃথিবীর প্রায় শেষ প্রান্তে, কানাডার অটোয়ায়। আদ্দিস আবাবা থেকে অতদূরে সরাসরি ফ্লাইট আছে কি না জানি না, তবে আমি যাচ্ছি ভেঙে ভেঙে। দাদুর ইচ্ছা পূরণ করতে! নিজের শিক্ষা জীবনকে পূর্ণতা দিতে। পৃথিবীতে সরাসরি আপনজন বলতে একমাত্র দাদুই বেঁচে আছেন। দাদু যে এত কষ্ট বুকে চেপে রেখেছেন, ঘুণাক্ষরেও কখনো টের পাইনি। টের পেতে দেনওনি। কী করে এত কষ্ট বুকে চেপে এতগুলো দিন পার করে এসেছেন? একটা মানুষ এত চাপা হয় কী করে? দাদুর কষ্টের কথাগুলো লিখতে গেলে ঢাউস এক মহাকাব্য হয়ে যাবে। প্রতিটি মানুষের জীবনই আসলে হাজারো মহাকাব্যের সমষ্টি! আমাদের পরিবারে সেই দাদাভাই থেকে শুরু করে আমি পর্যন্ত, প্রত্যেকের জীবনই নানা বিচিত্র ঘটনাপ্রবাহে ভরপুর! জীবন পরিক্রমার বাঁকগুলো শুধু কালকে নয় স্থানকেও ছুঁয়ে গেছে! দেশের সীমা ছাড়িয়ে মহাদেশীয় বলয়কে ধারন করেছে। ঘটনার শেকড় আমাদের ‘হারার’ হলেও শাখাপ্রশাখা বিস্তারিত হয়েছে আদ্দিস আবাবা,ইরিত্রিয়া, রোম হয়ে কানাডার অটোয়া পর্যন্ত!
.
হারার একটি ঐতিহ্যবাহী খান্দানী মুসলিম শহর। ইথিওপিয়ার সর্বপূর্বে, সোমালিয়ার সীমান্ত ঘেঁষা। ইউনেস্কো পুরো শহরটাকেই ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ’-এর অন্তর্ভুক্ত করেছে। এ-শহর থেকেই একসময় পুরো ইথিওপিয়াকে শাসন করা হয়েছে। পুরো আফ্রিকায় ইসলামের পতাকা বুলন্দ করা হয়েছে। আচ্ছা থাক, শহরের ইতিহাস নিয়ে পরে কথা বলা যাবে। প্রথমেই দাদা-দাদুর কথা না বললে, আমার আর জুমাইমার প্রসঙ্গটা অসংলগ্ন মনে হবে। অনেক চেষ্টা করেও দাদুর মুখ থেকে আমরা একটা শব্দও বের করতে পারিনি! আমাদের শরীরের রঙ একরকম, তার রঙ আরেক রকম কেন? তিনি সযত্নে প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যেতেন! সেদিনের মর্মান্তিক ঘটনার পর, আমি যখন ভীষণ মুষড়ে পড়লাম, তখন দাদু প্রায় অর্ধশতাব্দীর মৌনব্রত ভঙ্গ করলেন।
.
আমার প্রাথমিক লেখাপড়া শেষ হল। মাধ্যমিক শেষ। কলেজ শেষ হল। আমার ইচ্ছা ছিল রাজধানিতে গিয়ে পড়ার। আদ্দিস আবাবার ভাল ভার্সিটি ও মেডিক্যাল কলেজগুলোতে একমাত্র খ্রিস্টান ছেলেরাই পড়তে পারে। মুসলিমদের ভর্তির সুযোগ এখনো অবাধ হয়ে ওঠেনি। অবশ্য সম্রাট মরিয়াম হাইলে সেলাসির পতনের পর আস্তে আস্তে অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে। আব্বুর যা আয়রোজগার, তাতে আমার ভাল মেডিক্যাল কলেজে পড়ার ইচ্ছাটা ছিল আকাশকুসুম কল্পনা! তারপরও একদিন কথাপ্রসঙ্গে আম্মুকে বলে ফেলেছিলাম। তিনি শুনে আঁতকে উঠেছিলেন, বলে কি ছোঁড়া! একান ওকান করে আব্বুর কানে পৌঁছল! তারপর দাদাভাইয়ের কানে। রাতের দিকে পরামর্শ সভা বসল। টানটান উত্তেজনা নিয়ে ঘুমুতে গেলাম। ফজরের নামাজ পড়ে দাদুর ঘরে ডাক পড়ল। আব্বুও সেখানে বসে আছেন। একটু পর দাদু আর আম্মুও এলেন। দাদাভাই গলাখাকারি দিয়ে বললেন:
-বিলাল, আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তোমার ইচ্ছেটা আমরা যেভাবেই হোক পূরণ করব!
-দাদু, পরিবারের সবাইকে কষ্টে ফেলে, আমি উচ্চশিক্ষা চাই না! আর এটা আমার কোনও স্থায়ী ইচ্ছেও নয়। এক বন্ধু পড়তে যাবে, তার দেখাদেখি আমিও বলেছি।
-আচ্ছা, ঠিক আছে, তোমার ইচ্ছা নয়, আমাদেরই সিদ্ধান্ত। তুমি আদ্দিস আবাবায় পড়বে!
-ওখানে আমি একা একা কিভাবে থাকব? ঘরবাড়ি ছেড়ে আমি কখনো বাইরে থাকিনি!
-বাইরে থাকতে হবে না! ঘরোয়া পরিবেশেই থাকবে! কানাডিয়ান সরকারের এক কর্মকর্তার বাসায় থেকে তুমি পড়াশোনা করবে! রাতেই আমরা তার সাথে ফোনে কথা বলেছি! মানুষটা আমার পূর্বপরিচিত! কোনও সমস্যা হবে না।
.
দাদাভাই কখনো যা করেন নি, আমার জন্যে তাই করলেন। তিনি কখনো কানাডার কারো সাথে সম্পর্ক রাখতে চাননি। তিনি অতীতে একসময় কানাডায় ছিলেন, সেটাই জোর করে তার জীবন থেকে মুছে দিতে চেয়েছেন। শুধু আদরের নাতির জন্যে খোলস ছেড়ে বের হলেন।
.
ভর্তির কাজ শেষ। পরিবারের সবাই এসেছিলেন আমাকে ভর্তি করাতে। একা একা ছাড়তে চাননি! আব্বু-আম্মু, দাদা-দাদু। দুষ্ট ছোটভাইটাও। এতদিন সবাই মিলে একটা দেহের মতো ছিলাম। আমাকে দিয়ে ভাঙনের সুর বেজে উঠল। প্রথম কয়েকদিন জড়তা থাকলে, কাটিয়ে উঠতে সময় লাগল না। এতদিন ছিলাম সম্পূর্ণ রক্ষণশীল এক সমাজে। আশেপাশের সবাই কালো-বাদামি। এখন আছি একেবারে ভিন্নধর্মী এক পরিবারে। দাদা-দাদুর কারণে ইংরেজি ভাষায় বেশ ভাল দখল ছিল। তাই কানাডিয়ান পরিবারের সাথে থাকতে কোনও সমস্যা হয়নি। তারাও মোটে দুজন। স্বামী আর স্ত্রী। একটা সন্তান। কানাডাতেই থাকে। সেখানে পড়াশোনা করে।
.
আমাদের হারার রক্ষণশীল শহর। ইসলামি মূল্যবোধগুলো পরিপূর্ণরূপে বিদ্যমান। তদুপরি আমাদের পবিরার শহরের ধর্মীয় শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকার কারণে, শরীয়তের বিধানগুলো অন্যদের তুলনায় বেশিই মেনে চলে। মেজবান পরিবার সম্পূর্ণ উল্টো। তাদের চালচলন একদম ইউরোপিয়ান। তবে শালীন। মার্জিত। স্বামী-স্ত্রী উভয়েই আমাকে সন্তানের মত গ্রহণ করলেন। দাদু বলেছিলেন, কিছুদিন পর বোর্ডিংয়ে পাঠিয়ে দেবেন। আপাতত নতুন জীবনে অভ্যস্ত হয়ে নিক। আঙ্কল রোনে বললেন, তার প্রয়োজন নেই। ও আমাদের কাছে ছেলের মতোই থাকবে। আব্বুর ইচ্ছা আমি বোর্ডিংয়ে থাকি। এখানে থাকলে ইবাদত-বন্দেগীতে সমস্যা হবে। আঙ্কল এটাও নাকচ করে দিলেন। ওর যেভাবে ইচ্ছা থাকবে। কোনও সমস্যা হবে না।
.
পড়াশোনা চলছে। ছুটি হলে বাড়ি যাই। আব্বু-আম্মু আমাকে এগিয়ে নেয়ার জন্যে কয়েকটা শহর উজিয়ে চলে আসেন। তারা আমি পৌঁছার তর সইতে পারেন না। স্নেহের আতিশয্যে বেরিয়ে আসেন। আমি মানা করি,
-কেন কষ্ট করে আসেন, আমি তো আসছিই!
কিছুদিন পর দেখলাম, আব্বু তার এক বন্ধুর গাড়ি ভাড়া করে সবাইকে নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। পথের মধ্যে আমাকে বাস থেকে নামিয়ে গাড়িতে উঠিয়ে নেয়ার জন্যে। সবাই মিলে আনন্দ করতে করতে ঘরে ফেরা। আব্বু আম্মু আমাকে যে কী ভালবাসতেন, বলে বোঝানো যাবে না। আমি কখন বাড়ি ফিরব, কবে আমার ছুটি হবে, তার ‘পাইপয়সা’ হিশেব রাখতেন। দাদা-দাদুও আসতেন। ছোটভাই আমরও আসতো। লক্করঝক্কর মাইক্রোবাসটাতে যেন আস্ত হারার শহরটাই এঁটে যাবে।
.
বাড়িতে এসে দেখি সবার আচরণ একেবারে বদলে গেছে। আগে ছিলাম ‘তুই’ এখন হয়ে গেছি ‘তুমি’। আগে যা রান্না হতো, সেটাই মুখ বুজে খেতে হতো! এখন প্রতিবেলায় একবার দাদু, একবার আম্মু, একবার দাদাভাই, একবার আব্বু এসে খোঁজ নিয়ে যাচ্ছেন, পরের বেলায় কী খেতে ইচ্ছে করছে! খেতে বসেও কি নিস্তার আছে? সবার পাত খালি, আমার প্লেটে একটার পর একটা মাছের টুকরা, গোশতের টুকরা উঠছে! আদরের চোটে আমি কাহিল। শেষমেষ আর থাকতে না পেরে আম্মুর কাছে অভিযোগ করে বসলাম! আমাকে কেন এমন পর করে দেয়া হচ্ছে!
.
ছোটভাইটাও বদলে গেছে। আগে সারাক্ষণ আমার দোখ খুঁজে বেড়াত! তার বিচারের জ্বালায় ঘরে তিষ্টানো মুশকিল হয়ে যেতো! স্কুলে স্যারদের কাছে নালিশ দিয়ে প্রায়ই আমাকে পিটুনি খাওয়াতো! খেলতে গেলে, বড়ভাই বলে শ্রদ্ধা করা দূরের কথা, উল্টো ল্যাং মারতো! আমার প্রতিটি কথায় দশটা বিশটা ভুল বের করতো! সেও আমাকে তোয়াজ-তাজীম করে চলতে শুরু করল! যেন আমি এ-ঘরে মেহমান এসেছি! আম্মু বললেন:
-শোন ছেলের কথা! এতদিন পর দু’দণ্ডের জন্যে এসেছিস, সবাই তাই যত্নআত্মি করছে! তুই মেহমান হতে যাবি কোন দুঃখে?
.
এভাবে কলেজজীবন প্রায় শেষ। চূড়ান্ত পরীক্ষা ঘনিয়ে আসছে! পরীক্ষার আগে সবার দোয়া নেয়ার জন্যে একবার বাড়ি যাব দু’দিন পর! বাড়ি যাওয়ার দিন বেশ ভোরে আঙ্কেল এসে দরজায় টোকা দিলেন। দরজা খুলে আমি অবাক! এত ভোরে তিনি ঘুম থেকে জাগেন না। ঘুম ঘুম চোখে তিনি কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। ধীরপায়ে আমার খাটে এসে বসলেন। আমাকেও বসালেন। আমি অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম! তিনি কি কিছু বলতে এসেছেন? আমাকে আর থাকতে দিতে পারবেন না?
-বিলাল! একটু সমস্যা হয়েছে! তোমাকে কিভাবে যে বলি! একটু আগে হারার থেকে ফোন এসেছিল!
কেন যেন আমার সর্বশরীর ভীষণভাবে কেঁপে উঠল! ছোটখাট কোনও বিষয় হলে, ফোন আসার কথা নয়! কেউ মারা গেছে? দাদাভাই? নাকি দাদু? কিন্তু দু’জনেই শক্তপোক্ত! নীরোগ। অবশ্য জীবনমৃত্যু আল্লাহর হাতে। তিনি যখন যাকে ইচ্ছা তুলে নেবেন। কোনও অসুখ-বিসুখ ছাড়াই!
-আঙ্কেল, ওদিকে কোনও সমস্যা হলে নির্দ্বিধায় বলুন!
-আসলে ঠিক সমস্যা নয়, একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে! তোমাকে নেয়ার জন্যে তোমার পরিবারের সদস্যরা মাইক্রোবাসে করে এগিয়ে আসছিল! পথিমধ্যে একটা যাত্রীবাহী বাসের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে মাইক্রোবাসটা পাহাড়ের গভীর খাদে পড়ে গেছে!
আমার পায়ের তলার পৃথিবী বনবন করে ঘুরতে লাগল! মাথার ভেতরটা সম্পূর্ণ শূন্য আর ফাঁকা লাগল! কোনও সাড়া শব্দ নেই! নিঝুম একটা ভাব! আঙ্কেল আরো কি কি বলে গেলেন, আমি শুনতে পেলাম না! মাথাটা ঘুরে উঠল! পড়ে যাওয়ার উপক্রম হতেই তিনি আমাকে ধরে ফেললেন। হুঁশ ফিরতেই প্রথম প্রশ্নটা মুখ দিয়ে বের হয়ে এল:
-মাইক্রোতে কে কে ছিল?
-তোমার দাদু ছাড়া সবাই ছিল! তোমাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে হবে! দাদুর পাশে দাঁড়াতে হবে!
.
শুরু হল নতুন জীবন। আব্বু-আম্মুহীন, দাদা আর ছোটভাইহীন এক খাঁ খাঁ জীবন। দাদুকে সান্ত¡না দেব কি, উল্টো তিনি আমাকে আগলে রাখতে উঠেপড়ে লাগলেন। ঠিক করলাম পরীক্ষা দেব না। কী হবে পড়াশোনা করে! যা পড়েছি, তাতে এখানকার কোনও স্কুলে বা মাদরাসায় শিক্ষকতার চাকুরি পেতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। দাদু বেঁকে বসলেন। তিনি পারলে একপ্রকার আমাকে ধাক্কা দিয়েই আদ্দিস আবাবায় পাঠান আর কি! রাতদিন বোঝাতে লাগলেন! আমার সিদ্ধান্তকে ভুল বলতে লাগলেন! কিছুতেই আমাকে মানাতে না পেরে,
শেষ বললেন:
-বিলাল তুই কি আমার চেয়েও বেশি হারিয়েছিস? তুই মাকে পেয়েছিস, বাবাকে পেয়েছিস, দাদা-দাদু পেয়েছিস! নানা-নানু সবাইকে পেয়েছিস! আমি জীবনে কাউকে পাইনি! সেই বুঝ হওয়ার বয়েস থেকেই! আমি সবার থেকে, সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন! শেকড়হীন উন্মুল!
-তোমার বাবা-মাকেও পাওনি?
-ছয় বছর বয়েস পর্যন্ত পেয়েছিলাম। তারপর থেকে আর পাইনি! আমাদের বাড়ি ছিল কানাডার গ্র্যান্ড রিভার অঞ্চলে। আমাদের ‘ট্রাইব’ ওখানেই হাজার বছর ধরে বসবাস করে আসছিল! ষোড়শ শতকের দিকে ইংরেজরা দলে দলে আমেরিকা মহাদেশে ভীড় জমাতে শুরু করল। ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে লাগলো মহাদেশের আরও গভীরে। দখল করে নিতে শুরু করল একের এক জনপদ! আদিবাসি রেড ইন্ডিয়ানদেরকে উচ্ছেদ করে! নির্মূল করে! তাদের উপর গণহত্যা চালিয়ে!
.
এভাবে চলল দীর্ঘদিন! তারপরও রেড ইন্ডিয়ানরা দমে যায়নি। প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়ে যেতে লাগল। এতকিছুর পরও আমাদেরকে বিনাশ করতে না পেরে, তারা নতুন কৌশল গ্রহণ করল! আঠার শতকের গোড়া থেকে তারা আমাদেরকে নির্বংশ করতে শিশুহত্যা চালাতে শুরু করল।
এটাও ফলপ্রসূ হল না। এবার তারা অত্যন্ত সুচিন্তিত সুদূরপ্রসারী বিধ্বংসী কৌশল গ্রহণ করল। আমাদের শিশুদেরকে ছলেবলেকৌশলে, জোরযবরদস্তি করে মায়ের কোল থেকে কেড়ে নিতে শুরু করল।
-কেন? শিশুদের নিয়ে তারা কী করবে?
-তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন পদ্ধতির কিছু স্কুল খুলল! রেসিডেন্সিয়াল স্কুল নাম দিয়ে। স্কুলগুলোর পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল বিভিন্ন মতাদর্শের চার্চের হাতে। ফাদার আর নানরা সবকিছুর দেখভাল করত! দু’বছর হলেই আমাদের বাবা-মায়েরা ভয়ে সিঁটিয়ে থাকত, কখন শিশুলুটেরার দল আসবে! অনেক পরিবার সন্তান বাঁচাতে বনের আরও গভীরে চলে যেত! কিন্তু তাদের শাদা ডাকুদের কাছে তালিকা থাকত, কার সন্তান কখন হবে সেটার! কেউ তাদের হিংস্র থাকা থেকে মুক্ত থাকতে পারত না! একজন পালিয়ে গেলে, পুরো এলাকার উপর আকাশভাঙা নির্যাতন নেমে আসত!
.
রেসিডেন্সিয়াল স্কুলগুলো ছিল জেলখানার চেয়েও বেশি কিছু। আমরা হাসতে পারতাম না। নিজেদের ভাষায় কথা বলতে পারতাম না। ক্লাশের বাইরের কোনও বই-পত্রিকা পড়তে পারতাম না। আমরা একে অপরের সাথে বন্ধুত্ব করতে পারতাম না। ফাদার-নানরা বলতো, ভালবাসা শয়তানের কাজ।
.
ভাইরাস জাতীয় কোনও রোগে আমাদের কেউ আক্রান্ত হলে, তার সাথে শাস্তি হিশেবে নিয়মভঙ্গ করা সুস্থ্যদেরকেও শুইয়ে রাখা হত। এমনও হয়েছে, এই শাস্তির কারণে, পাঁচ ছয়জন শিশু একসাথে মারা গেছে। কোনও চিকিৎসা ছাড়াই!
.
ছোট ছোট বাচ্চাদের প্রচন্ড নির্যাতন করা হত। অনেকে মারা যেত। তাদেরকে গোপনে কোথাও মাটিচাপা দেয়া হত। কেউ কোনওদিন জানতেও পারবে না, তারা কোথায়। কেমন আছে।
.
একেকটা ডরমিটরিতে একটা করে টয়লেট ছিল। খাবার পানির কোনও ব্যবস্থা ছিল না। টয়লেট সব সময় ব্যস্ত থাকত। রাতদুপুরে কারো পিপাসা লাগলে, পানি খেতে হত, টয়লেট সাপ্লাই থেকে। বাইরে বের হওয়ার উপায় ছিল না। বরফপাত আর তুষার ঝড়ের কারনে। আর গেইটও বন্ধ থাকত।
.
রেসিডেন্সিয়াল স্কুলের প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীর মনে একথা বসিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হত, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে, ইন্ডিয়ান হয়ে জন্মানো একটি ‘সিভিয়ার ক্রাইম’। সবাইকে ইংরেজদের মতো হতে হবে। তাহলে অপরাধ কাটা যাবে। ফাদার নান থেকে শুরু করে সমস্ত স্টাফই পাশবিক মগজ ধোলাইকর্ম অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে করত!
.
আমাদেরকে সবকিছু করতে হত শাদা মানুষদের মত। পোশাক, খাবার-দাবার ওঠাবসা খেলাধূলা। কথাবার্তা। তারা আমাদের জীবন থেকে গড়ে ১১ বছর কেটে রেখে দিত। জীবনটাকে নষ্ট নিরস করে দিত। বাবা-মা সমাজ-রাষ্ট্র-সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিত। অসুস্থ হলে আমদেরকে দেখার কেউ ছিল না। সকালে সন্ধ্যায় কোনও আপনজনের ছোঁয়া ছিল না। তুচ্ছাতিতুচ্ছ অনিয়মেও শাস্তি ছিল অত্যন্ত কঠিন বর্বর অমানুষিক।
.
সারা কানাডা জুড়ে যত রেসিস্কুল আছে, সবগুলোর আকাশে বাতাসে কান পাতলে শোনা যাবে হাজারো শিশুর আর্তনাদ। আমরা প্রতি রাতেই কামনা করতাম ,ইশ আমি যদি আগামী কাল সকালে আর জেগে না উঠতাম। আমার যদি উড়ে যাওয়ার ক্ষমতা থাকত! আমার যদি মাটির নিচে চলে যাওয়ার শক্তি থাকত! আমাদেরকে নির্যাতন করার জন্যে মাটির নিচে বয়লার রূমে নিয়ে যাওয়া হত। মেশিনের বিকট আওয়াজে শিশুদের তীক্ষ্ন আর্তনাদ মিলিয়ে যেত। পরিসংখ্যান মতে শতকরা ২৪ জন শিশু রেসিস্কুলের নির্যাতন সইতে না পেরে মারা পড়ত।
.
সবাই প্রতীক্ষার প্রহর গুণত। কবে মুক্তির দিনটি আসবে। কবে বাবা-মায়ের কাছে ফিরে যাওয়ার অনুমতি মিলবে। বাড়ি গিয়েও মুক্তি মিলত না। পরিবার থেকে দীঘদিন বিচ্ছিন্ন থেকে, ভাষা-চালচলন সব আলাদা হয়ে গিয়েছে। কেউ কাউকে বুঝতে পারত না। এক শেকড়হীন অনুভূতি। প্রায় সাতটা প্রজন্ম জুড়ে দেড় লাখেরও বেশি শিশুকে কেড়ে নেয়া হয়েছে। তাদেরকে গড়ে তোলা হয়েছে শেকড়হীন করে। যাতে হানাদারদের বিরুদ্ধে ভবিষ্যতে কখনো রুখে দাঁড়াতে না পারে!
.
অনেক শিশুর পিঠ থেকে শুরু করে উরু পর্যন্ত ছিল ক্ষতবিক্ষত। চামড়ার মোটা বেল্ট দিয়ে পেটানো হত। আমাদের অনেকেরই শ্রবণশক্তি দুর্বল। কারণ আমাদের কানের উপর সজোরে থাপ্পর মারা হত। অনেক সময় উপুর্যপরি থাবার আঘাতে কান থেকে রক্ত ঝরত। কান পচে পুঁজ বের হত। চিকিৎসা নেয়ার উপায় ছিল না। ছয় সাত বছরের শিশুকে কান ধরে ছুঁড়ে ফেলা হত। মাথার উপর থেকে আছাড় মারা হত। অনেকের কোমরের হাড় আজো ভাঙা। আমার এক বান্ধবীকে, এক নান দোতলার জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলেছিল। ঘটনাস্থলেই মারা গিয়েছে।
.
ইউরোপিয়ানরা ইন্ডিয়ানদের গ্রামে চিকেন পক্সের জীবাণু ছড়িয়ে দিত। মারা পড়ত শত শত মানুষ। তাদের মুখ বন্ধ করতে এ-ব্যবস্থা নেয়া হত। তাদের সন্তানদের জড় কেটে দিতেই তারা এটা করত। ইন্ডিয়ান বসতিগুলো পরিকল্পিতভাবে প্লেগ ছড়িয়ে দেয়া হত। ছাত্রদেরকে ইলেকট্রিক চেয়ারে বসিয়ে শাস্তি দেয়া হত।
.
মিশনারী ডাক্তার ও ফাদাররা হাজারো নারী-পুরুষকে চিকিৎসার নামে বন্ধ্যা করে দিত। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের উপরও এমন নিগ্রহ হতো। সরকারের পক্ষ থেকে ডাক্তারকে প্রতিটি নারী বা পুরুষকে ‘স্টেরিলাইজড’ করার জন্যে ৩০০ ডলার করে দেয়া হত।
.
রেসিডেন্সিয়াল স্কুলের থাকাকালেই বহু মেয়ে গর্ভবতী হয়ে যেত। ফাদারদের নির্মম অত্যাচারে! অনেক সময় গর্ভবতী মেয়েকে তার সন্তানসহ মেরে ফেলা হত। অনেক সময় শুধুই সন্তানকে মারা হত। প্রতি সপ্তাহেই কেউ না কেউ আত্মহত্যা করত। অনেক সময় নানরা ছেলেদের দিয়ে নোংরা কাজ করাত। নিজেদের অবদমিত লিপ্সা চরিতার্থ করতে। ফাদাররাও ছোট ছোট ছেলেদের উপর অমানুষিক নির্যাতন চালাত।
.
অনেক সময় শিশুদেরকে পরিকল্পিতভাবে ড্রাগ এডিক্ট করে তোলা হত। তারপর স্কুল থেকে বের করে দেয়া হত। তারা কিছুদিন পর অসহায়ভাবে খোলা রাস্তায় পড়ে মারা যেত। অনেকের শরীরে এইচআইভিও পাওয়া যেত।
.
আমাদেরকে জোর করে খ্রিস্টধর্মে দিক্ষীত করা হত। আমাদের মধ্যে যাদের বুঝ হতো, তারা প্রথম প্রথম ক্রিশ্চিয়ানিটির রিচুয়াল পালন করতে অস্বীকৃতি জানাতো। তাদেরকে অত্যন্ত মর্মান্তিকভাবে প্রহার করা হত। চার্চে যেতে বাধ্য করা হত। আমরা যতদিন রেসি স্কুলে ছিলাম, বাইরের পৃথিবী সম্পর্কে কোনও ধারনাই পেতাম না। সেটা ছিল এক নির্মম বন্দী জীবন। একটানা ছয় সাত বা আট বা এগার বছর এখানে কাটাতে হত। কারো বেশি কারো কম।
.
কারো বাবা-মা সন্তানকে নিয়ে আসতে গেলে তাদেরকে পুলিশে দেয়া হত। কোনও কোনও স্কুলে ক্রিসমাসের দিন বাবা-মায়ের সাথে দেখা করারও সুযোগ দেয়া হত। আমরা পরস্পরেও ইন্ডিয়ান ভাষায় কথা বলতে পারতাম। এই একদিনের জন্যে তারা কেন উদারতা দেখাত, কী জানি। বাবা-মা সন্তানের সাথে চাইলে দেখা করতে পারত কোনও কোনও স্কুলে। তাও বছরে এক বা দুইবার। তবে গুণতে হত চড়া মাশুল।
.
১৮৩০ সালের দিক থেকে এ-স্কুল সিস্টেম চালু হয়। ১৯৯৬ সালে এসে এ ভয়াল যজ্ঞ পুরোপুরি শেষ হয়। অবশ্য আমাদের মোহাক ইনস্টিটিউট চালু হয়েছিল ১৮২৮ সালে। প্রায় দেড়শ বছর ধরে এই আদিম পাশবিক জংলি স্কুলব্যবস্থা ছিল। দেড় লক্ষেরও বেশি ছেলেমেয়েকে মায়ের কোল থেকে উপড়ে নিয়ে আসা হয়েছিল! পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি শিশুর কোনও হদিস নেই। শেষের দিকে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছিল। কিন্তু আমাদের ক্ষতি যা হওয়ার তা উনিশ শতকেই হয়ে গিয়েছিল!
.
আমি আমার বাবা-মাকে দেখিনি। তাদের সংবাদও বের করতে পারিনি। বের হওয়ার পর কত খুঁজেছি! আমাকে কোন এলাকা থেকে তুলে আনা হয়েছিল, তাও বের করতে পারিনি। জানি না আমার কোনও আত্মীয় বেঁচে আছেন কি না!
.
দাদু কথা বলছিলেন আর অঝোরে কাঁদছিলেন। আমার চোখেও বান ডেকেছিল। কী করে মানুষ এতটা অসভ্য হতে পারে? আমি শুধু আমার পরিবারকে হারিয়েছি, দাদু যে পুরো শৈশব-কৈশোর-বয়ঃসন্ধি ও নিজের জাতিকে হারিয়েছেন! কী দুঃসহ যন্ত্রণা বুকে চেয়ে দাদু এতদিন চুপ করে ছিলেন?
-দাদু এজন্যই তুমি বাম কানে শোন না?
-হাঁ রে ভাই! আরও অনেক সমস্যা!
-তুমি সেই কানাডা থেকে এই সুদূর আফ্রিকার হারারে কিভাবে এলে? দাদাভাইয়ের সাথে তোমার দেখা হল কোথায়?
-সে অনেক লম্বা কাহিনী! ডোরবেল বাজছে! কে এল দেখতো?
.
আমি ভেবেছিলাম আব্বুর কোনও বন্ধু বা পাড়া-পড়শি কেউ এসেছে! প্রতিদিনই কেউ না কেউ এসে সমবেদনা প্রকাশ করে যাচ্ছে! গতকাল আব্বুর এক কলিগ এসে আমার হাতে একটা খাম তুলে দিলেন। বললেন, তোমার আব্বু আমার কাছে পেতেন! আমি পরিষ্কার বুঝতে পারলাম, তিনি মিথ্যা বলছেন! আব্বুর প্রতি অসম্ভব ভালবাসা থেকে তারা এটা করছেন। এমন খাম একজন নয়, গত কয়েকদিনে বেশ কয়েকজন আমার হাতে গুঁজে দিতে চেয়েছেন। আমি বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করেছি।
.
দরজা খুলে আমি ভীষণ অবাক! আদ্দিস আবাবা থেকে আঙ্কল রোনে এসেছেন। সাথে এসেছে তার মেয়ে জুমাইমা। ভেবে কূলকিনারা করতে পারছিলাম না, ও কি কানাডা থেকে শুধু আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে উড়ে এসেছে? নাকি অন্য কিছু? মাথায় কালো স্কার্ফ!!! উড়ুউড়ু দস্যি মেয়ের মাথায় হঠাৎ কালো স্কার্ফ দেখলে একটু অন্যরকম লাগে বৈ কি।.
চলবে (ইনশাআল্লাহ)!
No comments:
Post a Comment